শিল্পী: রাষ্ট্রপতি ভবনে সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মৃণাল মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: ছোটবেলার কথা বলুন। ছবি আঁকা শুরু কীভাবে?
উত্তর: দাদা তখন মনে হয় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ওর ইতিহাস বইতে আবুল ফজলের ছবি দেখে এঁকেছিলাম। বাবা প্রশংসা করেছিলেন। বন্ধুরা তখন ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমিতে আঁকা শিখত। তাদের আঁকার খাতা দেখতাম। ভাল লাগত। বাবাকে বললাম, আমি আঁকা শিখব। সেই শুরু। আঁকার স্কুলে অনেক মজা হত। দু’টো ঘর ছিল। একটা ছোটদের, একটা বড়দের। বড়দের ঘরে ছোটরা খুব বেশি ঢুকতে পারত না।
প্রশ্ন: তখন ঝাড়গ্রাম কেমন ছিল?
উত্তর: আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের ঝাড়গ্রাম আর এখনকার ঝাড়গ্রামের অনেক তফাৎ। ছোটবেলায় ঝাড়গ্রাম শিল্প ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। আমি ঝাড়গ্রামে বসে সুরেশ দত্তের পুতুল নাচের শো দেখেছি। চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেছি। আশির দশকে ঝাড়গ্রাম শহরের সিনেমা হলে প্রতি রবিবার সকালে খুদেদের উপযোগী সিনেমা দেখানো হত। এখন তো ঝাড়গ্রামে সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা?
উত্তর: পড়াশোনা শুরু ঝাড়গ্রাম লায়ন্স মডেল স্কুলে। পুঁথিগত পড়াশোনায় কোনও দিনই খুব বেশি উৎসাহ ছিল না। তবে যে বিষয়গুলিতে ছবি আঁকতে হত, যেমন জীবনবিজ্ঞান, ভূগোল, জ্যামিতি—সেগুলিতে উৎসাহ ছিল। পোস্টার আঁকতে, চার্ট তৈরি করতে ভাল লাগত। স্কুলে অনেক নাটক করেছি। ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তার মধ্যে অন্যতম হল শৃঙ্খলা। মনে আছে, এক সন্ধ্যায় সেখানে নাচের অনুষ্ঠান ছিল। তার আগে ঝড়-বৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ ছিল না। তবু কিছু মানুষ এসেছিলেন। তাদের জন্য সঠিক সময়ে মোমবাতি জ্বেলে নাচের অনুষ্ঠান হয়েছিল। এই শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে জীবনে সফল হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
প্রশ্ন: নাটকের কথা বলুন।
উত্তর: প্রথম নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’। ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমিতেও নাটক হত। অভিনয় করতে ভাল লাগত। শিল্পকলার কাজ করতে এসে নাটকের শিক্ষা কাজে এসেছে।
প্রশ্ন: ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
উত্তর: আমার বাড়ি যেখানে তার পিছনে বস্তি এলাকা ছিল। সেখানে অনেক বিহারি ও নেপালি থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছি। গাছে উঠে আম পেড়েছি। ঝাড়গ্রামে গেলে দেখা হয়। কেউ পানের দোকান করেছে, কেউ অটো চালায়। দেখা হলে চিনতে পারে। গল্প করে।
প্রশ্ন: কেরিয়ায়ের শুরুর দিনগুলো?
উত্তর: কলকাতায় যখন প্রথম যাতায়াত শুরু করেছিলাম তখন এই শহরের একজনও আমার চেনা ছিল না। পদ্মাবতের শিল্প নির্দেশক সুব্রত (চক্রবর্তী) ঝাড়গ্রামের ছেলে। আমার বন্ধু। ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, আমি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। আমি যখন মাস্টার ডিগ্রি করছিলাম তখন সুব্রত আমাকে প্রখ্যাত প্রোডাকশান ডিজাইনার সমীর চন্দের কাছে গিয়েছিল। সেই সময়ে প্রচুর লড়াই করতে হয়েছে। স্টিল এক্সপ্রেসে কলকাতায় আসতাম। কাজ মিটিয়ে রাতে স্টিল এক্সপ্রেসেই ঝাড়গ্রাম ফিরতাম। মাস্টার ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘বোস, দ্য ফরগটেন হিরো’র প্রোডাকশনে যোগ দিই। দিনটা ছিল ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি। তারপর বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, জাপানে আমার ছবি গিয়েছে। ২০০৮ সালে মুম্বইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করেছিলাম। কলকাতাতে অনেক কাজ করেছি। এখনও করছি।
প্রশ্ন: কোনও মানুষ যিনি আপনার জীবনকে প্রভাবিত করেছেন?
উত্তর: কিশোর চট্টোপাধ্যায়। নিজে শিল্পী ছিলেন এবং সঙ্গীত ও ছবির সমালোচক ছিলেন। সম্ভবত আমি ২০০০ সালে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করি পার্ক হোটেলের উল্টো দিকে এক গ্যালারিতে। তখন সদ্য স্নাতক হয়েছি। কিশোরদাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। উনি এসেছিলেন। পরে জেনেছিলাম, ওই প্রদর্শনীর আগেই একটি হোটেলের করিডরে উনি আমার আঁকা ছবি দেখেছিলেন। তারপর থেকে আমি উনি আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যা খুবই কাজে লেগেছিল। কিশোরবাবুর হাত ধরেই মকবুল ফিদা হুসেন, জাহাঙ্গির সাভাবালার প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: বিশ্ববাজারে ভারতীয় শিল্পকলার অবস্থা এখন কেমন?
উত্তর: ভাল নয়। এখন তো বাড়িতে সাজিয়ে রাখার জন্য একটি ছবি হলেই হল। কত জন মানুষ শিল্পের কদর দিতে পারেন? মাঝে কিছু লগ্নিকারী চিত্রশিল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই মুখ ঘুরিয়েছেন। ভাল ছবিও দাম পাচ্ছে না। বাংলার কথাই ধরা যাক। এখানে অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদের আঁকার ক্লাসে ভর্তি করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্লাস এইট হয়ে গেলেই প়ড়ার চাপের অজুহাত দেখিয়ে আঁকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সদর্থক ভূমিকা নিলে এই অবস্থা বদলাতে পারে।
প্রশ্ন: কেন? শিল্পকলার প্রসারের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কি কিছু করণীয় আছে?
উত্তর: আমি মনে করি অবশ্যই আছে। তাদের সহযোগিতা পেলে অনেক কিছু সম্ভব। একটা উদাহরণ দিই, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সামনে যে দু’টি পাথরের মূর্তি রয়েছে সেগুলি বানিয়েছেন রামকিঙ্কর বেইজ। সেগুলি তৈরির আগে রামকিঙ্করবাবু কেন্দ্রীয় সরকারকে খরচের যে কোটেশন দিয়েছিলেন অর্ধেক কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেই টাকা শেষ হয়ে যায়। হয়তো বৈষয়িক বিষয় নিয়ে রামকিঙ্করবাবুর তেমন ধারণা ছিল না। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। রামকিঙ্করবাবু প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি জানানোর পরে তিনি নতুন করে টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। শুধু রামকিঙ্করবাবু নয়, নন্দলাল বসুর সঙ্গেও ইন্দিরা গাঁধীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
প্রশ্ন: এখন সমস্যা কোথায়?
উত্তর: ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অনেক প্রতিভা রয়েছে, কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। বিশ্ব বাজারে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। কাজের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো দরকার। জায়গা দরকার।
প্রশ্ন: এমন কোনও শিল্পী যিনি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেন?
উত্তর: ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক অনীশ কপূর, চিনের আই ওয়াই ওয়াই। অনীশ কপূরের পৃষ্ঠপোষক লক্ষ্মী মিত্তল। তিনি এক বিশেষ ধরনের কালো রংয়ের স্বত্বটাই কিনে নিয়েছেন। ওই রংটা বিমান তৈরিতে কাজে লাগত। আই ওয়ে ওয়ে চিনে থেকে চিনের সরকারের বিরুদ্ধে ছবি আঁকেন। সরকার তাঁকে নজরবন্দি করেছিল। সেই ঘটনার প্রতিবাদে তিনি একটি স্থাপত্য তৈরি করেছিলেন। সেখানে কমোডে বসে থাকা এক ব্যক্তির দু’পাশে বন্দুকধারী দু’জন সেনা দাঁড়িয়ে আছে। তিনিই সূর্যমূখী বীজের সঙ্গে চিনের জনসংখ্যার তুলনা করেছেন। এই শিরদাঁড়া সোজা করা বিষয়টাই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজের কাজ দেখেও অনেক কিছু শিখি। এদের তুলির টান কী শক্তিশালী!
প্রশ্ন: মফস্সলে বড়ো হয়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন? কোনও সমস্যা?
উত্তর: (একটু হেসে) মূল সমস্যা হল তুমি যদি মফস্সলের হও, তো শহরের মানুষ তোমায় কিছুতেই স্বীকৃতি দিতে চাইবে না।
প্রশ্ন: প্রথম ছবি কবে বিক্রি হয়েছিল?
উত্তর: তখন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার একটি ছবি আট হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। ছবিটি পেনসিল স্কেচের ছিল।
প্রশ্ন: এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
উত্তর: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছি। সামগ্রিক কাজ। যার মধ্যে অনেকগুলি বিষয় রয়েছে। মানুষ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়—সেই ভাবনা থেকেই এই কাজ। মানুষ তো রুটিনে অভ্যস্ত। কিন্তু কীসের লক্ষ্যে এই ছুটে চলা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। মকবুল ফিদা হুসেন বলেছিলেন, কোনও ছবির শুরু নেই, শেষ নেই। কেন? ধরো, আমি কোনও ছবি আঁকলাম। কিন্তু তার মানে কী সেই ছবি আঁকা শেষ? নয়। কারণ সেই ছবিতে একটি ফুটকি দিলেই কিন্তু সেই ছবি আঁকা ফের শুরু হয়ে যাবে। গত বছর রাষ্ট্রপতি ভবনে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সাহাবুদ্দিন আহমেদ এসেছিলেন। তাঁর ছবির প্রদর্শনীর জন্য। সেখানে ছবি সাজানোর দায়িত্বে আমি ছিলাম।
প্রশ্ন: এখন ঝাড়গ্রামে যাওয়া হয়?
উত্তর: ওখানে বাবা-মা ও দাদা-বৌদি থাকেন। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারের সবাই পাশে না থাকলে হয়তো কিছুই করতে পারতাম না। বছর কয়েক আগে ঝাড়গ্রামের একটি বিশাল উইঢিপি নিয়ে কাজ করেছি। এখন তো ঝাড়গ্রামে অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। এই নিয়ে প্রতিবাদ হওয়া দরকার। চালচিত্র অ্যাকাডেমি নামে একটি সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত রয়েছি। কলকাতাকেন্দ্রিক এই সংস্থাটি মূলত দেশজ শিল্প নিয়ে কাজ করে। ভবিষ্যতে ওই সংস্থাকে ঝাড়গ্রামে নিয়ে এসে কাজ করানোর ইচ্ছে রয়েছে।
প্রশ্ন: মফস্সল থেকে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের জন্য কী বলবেন?
উত্তর: আবার মকবুল ফিদা হুসেনের কথা ধার করতে হয়। উনি বলতেন, শিল্প হল সার্বিক ব্যাপার। এর কোনও সহজ রাস্তা নেই। পরিশ্রম করতে হবে। সেই তাগিদটা এখন কমই দেখি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy