এলাকায় এসিজেএম আদালতের পরে জোরাল হচ্ছে মহকুমার দাবি। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
নামের শুরুতেই রয়েছে ‘গড়’। যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এখানে কোনও এক রাজার রাজত্ব ছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণ এড়াতে তিনি তৈরি করেছিলেন এই ‘গড়’। কিন্তু কোন রাজা এই গড়ের পত্তন করেছিলেন, কীভাবে সেই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটল, এ নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে।
কথিত আছে, প্রাচীন যুগে এই গড়বেতা ‘বকদ্বীপ’ নামে পরিচিত ছিল। প্রায় সাড়ে ৪০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ছিল বকদ্বীপের বিস্তৃতি। যা ছিল বকাসুরের অধীনে। পরে ভীম এসে বকাসুর বধ করেন। গড়বেতা নামের উৎপত্তি সংক্রান্ত কিছু প্রাচীন নথিও রয়েছে। যা থেকে জানা যায়, গুপ্ত যুগে বেত্র বর্মা নামে এক রাজা প্রথম গড়বেতার পত্তন করেন। গড় সুরক্ষিত করতে চারিদিকে পরিখাও তৈরি করেন।
সেই সময় গড়ে ঢোকার জন্য ছিল চারটি ফটক। লালগেট, পেশা গেট, রাউত্ গেট ও হনুমান গেট। কোনও গেটেরই এখন অস্তিত্ব নেই। তবে পূর্বদিকে যে রাউত্ গেটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই অংশে রাউত্ পুকুর নামে একটি জলাশয় রয়েছে!
বিভিন্ন নথি থেকে আরও জানা যায়, এক সময় ওড়িশার রাজাদের দখলে ছিল গড়বেতা। পরে বিভিন্ন সময়ে হাতবদল হয় গড়বেতার দখন। শেষে সিংহ বংশ রাজত্ব করেন। পরে ইংরেজরা গড়বেতা দখল করার চেষ্টা করলেও মাথা নত করেননি সিংহ বংশের রাজারা। শুরু হয় বিদ্রোহ। যার নাম চুয়াড় বিদ্রোহ। সেনাপতি অচল সিংহ বীর বিক্রমে লড়াই করেও পরাস্ত হন। ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার পর অচল সিংহকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
গড়বেতার অন্য এক ইতিহাসও রয়েছে। গড়বেতা এক সময় ‘মহকুমা’ ছিল! যার স্বীকারোক্তি রয়েছে ১৯৯৫ সালের ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স’-এ। তাতে উল্লেখ রয়েছে, খুব কম সময়ের জন্য গড়বেতা মহকুমার সদর দফতর ছিল। ২০০০ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ’ যে সংসদ পরিচিতি প্রকাশ করেন (নব পর্যায়ে সেপ্টেম্বর, ২০০০), তাতেও উল্লেখ রয়েছে গড়বেতা এক সময় মহকুমা ছিল। তাতে লেখা হয়েছে, ‘১৮৭২ সালের পূর্বে ঘাটাল হুগলি জেলার জাহানাবাদ (আরামবাগ) মহকুমার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৮৭২ সালে মেদিনীপুরের অধীন গড়বেতা মহকুমার অন্তর্গত হল এবং ১৮৭৬ সালে ঘাটাল মহকুমা হিসাবে পরিচিত হল।’
অতীতের কথা তুলে গড়বেতার মানুষ নতুন করে মহকুমার দাবি তোলেন। তৈরি হয় গড়বেতা মহকুমা উদ্যোগ কমিটি। এই কমিটি-র যুক্তি ছিল, গড়বেতা তিনটি ব্লকে বিভক্ত। যার এলাকা প্রায় ৮৯০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ। প্রায় সাড়ে ৯০০ মৌজা রয়েছে। তারই সঙ্গে এই কমিটি দাবি করে, চন্দ্রকোনা-২ ও কেশপুর ব্লকের কিছুটা এর সঙ্গে যুক্ত করে দিলে একটি মহকুমা করা অতি যুক্তিসঙ্গত।
কেন মহকুমার দাবি? গড়বেতা মহকুমা উদ্যোগ কমিটির দাবি, মহকুমা হলে শহরের প্রভূত উন্নতি ঘটবে। হাসপাতাল মহকুমা হাসপাতালে উন্নীত হবে। বিভিন্ন অফিস হবে। সাধারণ মানুষকে ছোটখাটো কাজের জন্য আর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে মেদিনীপুর শহরে দৌড়তে হবে না। কমিটির সম্পাদক শ্যামল কুমার মহাপাত্রের কথায়, “মহকুমা তো দূরের কথা, গড়বেতা এখনও পুরসভাও হল না। এটাই আক্ষেপ। জীবনকালে কী আর গড়বেতাকে পুরসভা ও মহকুমা হিসাবে দেখতে পাব!”
২০০১ সালে মেদিনীপুর জেলা ভাগের সময় কমিটির পক্ষ থেকে তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে এই দাবিও জানানো হয়েছিল। গড়বেতার তৃণমূল নেতা অসীম ওঝা বলেন, “তখন বিধানসভার দলনেতা ছিলেন আমাদের দলের পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও আমাদের হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। তবু মহকুমা করা যায়নি।” কমিটির সম্পাদক জানান, এ বার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও এই দাবি নিয়ে যাবেন। সকলেই চান, গড়বেতাকে দ্রুত পুরসভা করা হোক। করা হোক আলাদা মহকুমাও।
গড়বেতাবাসীর প্রশ্ন, বেলদা পুরসভা হলে গড়বেতা নয় কেন? গড়বেতার পুরনো ঐতিহ্য উদ্ধারে তাই আবার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। শ্যামলবাবুর কথায়, “গড়বেতা যে এক সময় মহকুমা ছিল, গড়বেতাকে যে মহকুমা করলে উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে, তাতে মানুষের লাভ হবে জানাতেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব।” জেলাভাগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ঝাড়গ্রামকে নতুন জেলা করার চেষ্টা চলছে। তখন যদি গড়বেতা মহকুমার মর্যাদা না পায় তাহলে ভবিষ্যতে আর গড়বেতার পুরনো ঐতিহ্য উদ্ধার হবে কি না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাই আবার নতুন করে গড়বেতাকে মহকুমা করার দাবিতে এগোতে চাইছেন গড়বেতার মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy