Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lockdown in India

ফর্ম ডাব্বায় ফেলে দে, বলল পুলিশ

ঘরে ফিরছি আমিও। লকডাউনে প্রায় ৭০ দিন পুণেতে আটকে থেকে বিস্তর হয়রানির পরে ফিরছি খড়্গপুরে। সড়কপথে।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

জাহির চৌধুরী শিক্ষক, খড়্গপুর
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২০ ০৩:০৮
Share: Save:

হাইওয়ে দিয়ে গড়িয়ে চলেছে ট্রেলার। পরপর রাখা ট্রেনের চাকা। আমাদের গাড়িটা ট্রেলারের কাছে আসতেই দেখলাম, চাকাগুলোর গায়ে লেপ্টে রয়েছে মানুষ। বিশাখাপত্তনম পেরিয়ে আমরা তখন ওড়িশার দিকে। মে মাসের গরমে ধাতব চাকাগুলো তো আগুনে-গরম হওয়ার কথা! আর একটা ট্রেলারে বোঝাই করা বাইক। তারও ফাঁকগুলো মানুষ দিয়ে ঠাসা।

ভুল না হলে ওঁরা পরিযায়ী শ্রমিক। প্রাণ হাতে ঘরে ফিরছেন।

ঘরে ফিরছি আমিও। লকডাউনে প্রায় ৭০ দিন পুণেতে আটকে থেকে বিস্তর হয়রানির পরে ফিরছি খড়্গপুরে। সড়কপথে। সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। পুণের ভারতী বিদ্যাপীঠ থানার সেই কনস্টেবলের মুখটা মনে পড়ছে। শ্রমিক স্পেশালে ফেরার জন্য থানায় আবেদনপত্র জমা দিতে গিয়েছিলাম। ‘‘কোথায় ফর্মটা জমা দেব স্যর?’’ কনস্টেবল বলেছিলেন, ‘‘আবে তু উধার রুক। ও জো ডাব্বা দিখতা না, উসমে ডাল দে।’’ তুইতোকারি শুনেও ঠান্ডা মাথায় জানতে চেয়েছিলাম, শ্রমিক স্পেশালে ডাক পাব তো? পুলিশকর্মীটি বাছাই বিশেষণ-সহ বলেছিলেন, ‘‘তেরে কো কেয়া লাগতা হ্যায়, হাম **য়া হ্যায়? ফর্ম জব জমা লিয়া, জরুর বুলায়া জায়েগা।’’

দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়েছে জেনেও অসুস্থ ছোট বোনকে দেখতে ১৬ মার্চ সকালে পুণেতে পৌঁছেছিলাম। দেখেছিলাম, স্টেশন স্বাভাবিক। অনেকে মাস্ক পরেছেন, অনেকে পরেননি। অবস্থা পাল্টাতে শুরু করল চতুর্থ দিন থেকে। ফেরার টিকিট ছিল ২৩ মার্চ। সে দিনই রেল জানাল, ৩১ মার্চ পর্যন্ত ট্রেন বন্ধ। অনলাইনে ২ এপ্রিল টিকিট কাটলাম। তার আগেই লকডাউন ঘোষণা হল।

তখন চিন্তাটা বেশি ছিল চিকি‌ৎসা করাতে গিয়ে ভেলোরে আটকে পড়া বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে। দ্বিতীয় দফার লকডাউন ঘোষণা হতেই ভয় পেলাম। ফোন করলাম আমাদের রেলশহরের বিধায়ক তথা পুরপ্রধানকে। তিনি আশ্বাস দিলেন, মহকুমাশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন। দিন দশেক কাটল। বিধায়ক আর ফোন ধরেননি। আর মহকুমাশাসক বললেন, ‘‘কোথায় আটকে আছেন, জানিয়ে মেসেজ করুন। সরকারি উদ্যোগে কোনও ব্যবস্থা হলে অবশ্যই খবর দেব।’’

ভাল খবর একটাই। লাখখানেক টাকায় অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে ভেলোর থেকে খড়্গপুরে ফিরেছেন বাবা। তৃতীয় দফার লকডাউন শুরু হতে বাবা বললেন, ‘‘ট্রেনের চিন্তা ছেড়ে গাড়িতে ফিরে এসো।’’ শুরু হল আর এক যুদ্ধ। একটা গাড়ি ঠিক করলাম। সব তথ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েবসাইটে ‘এন্ট্রি পাস’-এর আবেদন করলাম। পুণের বেসরকারি হাসপাতালে আমাদের সকলের করোনা পরীক্ষা করালাম। যাবতীয় নথি-সহ পুণে পুলিশের কাছে অনলাইনে আবেদন করলাম। চার বারই কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে বাতিল হল আবেদন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া নোডাল অফিসারের নম্বরেও সাড়া পাইনি।

১২ মে পুণের এক ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ হল। পাস করিয়ে দেওয়া ও খড়্গপুরে পৌঁছে দেওয়ার পারিশ্রমিক মিলিয়ে হাজার ষাটেক টাকায় রফা হল। ২১ মে বেরিয়ে পড়লাম পুণে থেকে। পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ভারত হয়ে পূর্বে ফেরা। সর্বত্রই রাস্তায় দেখেছি ঘরমুখো বিধ্বস্ত চেহারাগুলো। বাড়ি পৌঁছলাম ২৩ মে ভোরে। ১৪ দিনের গৃহ-নিভৃতবাসে থেকে বারবার মনে হচ্ছে, আচমকা অপরিকল্পিত এই লকডাউনের কি প্রয়োজন ছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lockdown in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE