Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সাবধান! বিপদ লুকিয়ে ফুলদানিতে

জ্বরে আক্রান্ত এবং তাঁর পরিজনেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ডেঙ্গি হলে। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। ডেঙ্গি ঠেকাতে সাধারণ কিছু সচেতনতা প্রয়োজন। সে বিষয়ে সচেতন করলেন রবীন্দ্রনাথ প্রধানজ্বরে আক্রান্ত এবং তাঁর পরিজনেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ডেঙ্গি হলে। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। ডেঙ্গি ঠেকাতে সাধারণ কিছু সচেতনতা প্রয়োজন। সে বিষয়ে সচেতন করলেন রবীন্দ্রনাথ প্রধান

অস্বাস্থ্যকর মশার আঁতুড়ঘর। খড়্গপুর শহরে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

অস্বাস্থ্যকর মশার আঁতুড়ঘর। খড়্গপুর শহরে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

আবহাওয়ার খেয়ালি আচরণে কাবু হচ্ছে বিশ্বের মানুষ। বাদ নেই বাংলাও। আবহাওয়া পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। মশককুল কিন্তু সেই বদলের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। আর তাই গরম হোক কিংবা শীত—ডেঙ্গির আতঙ্ক তাড়া করছে রাজ্যের শহর থেকে গ্রামে। সবচেয়ে বেশি ভুগছে বাচ্চারা।

ডেঙ্গি থেকে বাঁচতে সবার আগে চাই সচেতনতা। কিন্তু সেটার অভাবই প্রকট সব জায়গায়। মশার আঁতুড়ঘর কিন্তু মানুষের হাতেই তৈরি। সচেতন ভাবে বা স্বভাবের কারণে মশার বংশবৃদ্ধিতে মানুষই সাহায্য করে। চায়ের ভাঁড়, দইয়ের ভাঁড়, প্লাস্টিক ব্যাগ, পরিত্যক্ত টায়ার, শিশি, টব, ডাবের খোলা, খোলা জায়গায় ফেলা বা রাখা উচিত নয়। কিন্তু নিষেধ থাকলেও সে সব শুনছে কে? বর্ষাকালে ফুলের টবে বৃষ্টির জল জমে মশার বংশবৃদ্ধি হয়। বিষয়গুলি নিয়ে বার বার সচেতন করা হয়। টিভিতে প্রচার চলে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধিরাও সে কাজ করেন। কিন্তু পরিস্থিতি সেভাবে বদলায়নি।

ডেঙ্গির ভাইরাসবাহী মশা সাধারণত ২১-৩০ দিন বাঁচে। সেগুলো বাড়ির ৫০-১০০ মিটার এলাকার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই মশার বংশ ধ্বংস করতে কয়েকটি পদ্ধতি নিতেই হবে। রোগ ছড়ানোর নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। জলবাহিত, মাটিবাহিত, মশাবাহিত, বায়ুবাহিত প্রায় সব ধরনের রোগের জীবাণু প্রথমে পরিবেশে আসে। সেখান থেকে সেই জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তাই পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে এলাকার বাসিন্দাদের সবসময় সজাগ থাকতে হবে। বাড়ির চারপাশে কিংবা ছাদে জমা জল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

ডেঙ্গির মশা কিন্তু ফ্রিজে জমে থাকা জলেও জন্মাতে পারে। ওই জল সপ্তাহে দু’বার ফেলা উচিত। জনসচেতনতাই হল রোগ বিনাশের সবচেয়ে ভাল উপায়।

যত বেশি সচেতনতা গড়ে তোলা যায়, ততই রোগ প্রতিরোধের পক্ষে ভাল। কোনও শুকনো জায়গায় অহেতুক কীটনাশক স্প্রে না করাই উচিত। এতে পরিবেশের ক্ষতি এবং অর্থের অপচয় দুই-ই হয়। গোধূলির সময়ে বাড়িতে রাখা পানীয় জলের পাত্রগুলো কাপড়ে ঢেকে রাখা উচিত। জলের ট্যাঙ্ক কিংবা ভূগর্ভস্থ জলের রিজার্ভারের মুখও সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। ট্যাঙ্কের গায়ে ফুটো থাকলে সারিয়ে ফেলতে হবে।

সাধারণত জ্বর, চোখের পিছনে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, হালকা র্‌, জ্বর ছেড়ে গেলেও দুর্বলতা—এগুলিই হল ডেঙ্গির প্রাথমিক উপসর্গ। একটি বাড়ির একাধিক সদস্যের ডেঙ্গি হতে পারে। কারণ ডেঙ্গি মশার ডিম ফোটানোর জন্য রক্তের দরকার হয়। তাই তারা বেশি বার কামড়ায়। ডেঙ্গি পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি হল অ্যালাইজা বা আইজেএম পদ্ধতি। র‌্যাপিট কিটের মাধ্যমে পরীক্ষা করলে বেশিরভাগ রিপোর্টই ভুল আসে। কিন্তু অ্যালাইজা পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে রিপোর্ট ভুল হওয়ার সম্ভবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

জ্বরের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে অ্যালাইজা পদ্ধতিতে ডেঙ্গি এনএস-১ অ্যান্টিজেন ও পাঁচ দিন পরে অ্যালাইজা পদ্ধতিতে ডেঙ্গি আইজেএম পরীক্ষা করা উচিত। ডেঙ্গি হলে বেশি করে জল ও প্যারাসিটামল খেতে হবে। নিতে হবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম। কোনও ঠান্ডা পানীয় খাওয়া যাবে না। ওআরএস, ফলের রস, ডাবের জল বেশি করে খেতে হবে। ডেঙ্গি হলেই যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, তেমন নয়। অনেক সময় সতর্কতা নিয়ে বাড়িতে থাকলে ডেঙ্গি সেরেও যায়। সারা বছর যদি মশারি ব্যবহারের অভ্যাস করা যায় তাহলে ডেঙ্গির মশাকে অনেকটাই ঠেকানো যায়। মশারি ব্যবহারের কেন প্রয়োজন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এক পরিচিতের মশারি টাঙিয়ে শুতে অসুবিধা হতো। ঘুম আসত না। উনি মশারি না টাঙিয়ে ঘরে লিক্যুইডেটর ব্যবহার করতেন। তবুও তাঁর ডেঙ্গি হয়েছিল। কারণ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সময় ঘুমের ঘোরে মশা কামড়ায়।

ডেঙ্গি হলে পরিবারের অন্য সদস্যেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কী করবেন ভেবে পান না। অহেতুক ছোটাছুটি করেন। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গি হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতেই হবে। প্লেটলেট যদি ১০ হাজারের নীচে নেমে যায়, তাহলে আলাদা করে প্লেটলেট নিতে হবে। তবে এটা জেনে রাখা ভাল, প্লেটলেট কম থাকার জন্য সাধারণত মৃত্যু হয় না।

ডেঙ্গির জটিলতা বাড়ে শরীরে জলশূন্যতার কারণে। সেটাই মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হয়ে ওঠে। সাধারণত, জ্বর শুরুর তিন দিন পর থেকেই রোগীর শরীরে প্লেটলেট কমতে শুরু করে। এর অন্যতম কারণ শরীরে জলশূন্যতা। রোগী জ্বরের কারণে জল খেতে চান না। শরীরে যদি জলের পরিমাণ কম না থাকে তাহলে ৬ দিন পরে প্লেটলেট আবার বাড়তে শুরু করে। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার অন্তত ২-৩ দিন পর পর্যন্ত রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখা দরকার।

আবারও বলা প্রয়োজন, রোগের আগে সতর্কতা বেশি জরুরি। ডেঙ্গির হাত থেকে বাঁচতে আগে বাড়ির আশপাশ নিয়মিত পরিষ্কার রাখতেই হবে। খোলা জায়গায় পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের কাপ, চায়ের ভাঁড়, দইয়ের ভাঁড়, ডাবের খোলা, শিশি-বোতল, ঘরে আবর্জনা যাতে না থাকে নজর দিতে হবে। টেবিলে সুন্দর করে সাজানো ফুলদানির জলও সাত দিনে একবার বদলাতে হবে। নয়তো ডেঙ্গির মশা তাতেও ডিম পাড়তে পারে।

সব মিলিয়ে, একটু সজাগ থাকলেই এই রোগ এড়ানো সম্ভব।

লেখক পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mosquito Larvae Flower Vase Refrigerator
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE