হতশ্রী মন্দিরের দেওয়াল দেখাচ্ছেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ইয়াসিনপাঠান। — নিজস্ব চিত্র
প্রায় তিনশো বছরের পুরনো পাথরার কালাচাঁদ মন্দির। স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে মন্দিরের দালানে বসতে গিয়ে থমকে গেলেন হাওড়ার পলশ্রী কুশারী। দেওয়াল জুড়ে ইট, খড়ি, কয়লা দিয়ে লেখা ভালবাসার অক্ষর গিজগিজ করছে। হৃদয় চিহ্নে প্রেমিক-প্রেমিকার নাম শুধু নয় রয়েছে অজস্র অশ্লীল শব্দ, এমনকী ছবিও।
পেশায় স্কুলশিক্ষিকা পলশ্রীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘ছেলেকে প্রাচীন মন্দির দেখাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এ কী অবস্থা!’’
৪৫ ফুট উঁচু নবরত্ন মন্দিরও রেহাই পায়নি। প্রবেশ পথের দেওয়ালে ৯ ফুট উঁচুতে জ্বলজ্বল করছে ভালবাসার বিজ্ঞাপন— ‘চিত্রা প্লাস অনু’।
ভালবাসার এমন আঁচড়েই হতশ্রী মন্দিরময় পাথরার অনুপম সব স্থাপত্য নির্দশন। পশ্চিম মেদিনীপুরের এই গ্রামে কয়েকশো বছরের পুরনো টেরাকোটার মন্দিরগুলি অধিগ্রহণ করেছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)। ‘হেরিটেজ’ স্বীকৃতি পেয়েছে ঐতিহাসিক এই পর্যটন কেন্দ্রের মন্দিরগুলি। সংস্কার হওয়া নবরত্ন মন্দির, কালাচাঁদ মন্দিরের দালান, রাসমঞ্চ, ধর্মরাজের মন্দির, জমিদারের কাছারি বাড়ির মতো প্রায় প্রতিটি স্থাপত্যের দেওয়ালও কুরুচিকর শব্দে ক্ষত-বিক্ষত। শুধু তাই নয়, নির্জন কাছারি বাড়িটির ভিতরে তো কার্যত শৌচাগার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কলকাতা থেকে আসা অত্রি সাহা, ঝিলিক মজুমদাররা বলছেন, “মন্দিরময় পাথরার নাম শুনে এসেছিলাম। কিন্তু এ তো দৃশ্য দূষণ!”
পাথরার মন্দিরের স্বীকৃতি আদায়ে যাঁর নিরলস আন্দোলন রয়েছে, সেই ইয়াসিন পাঠানও বিপর্যস্ত। পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ইয়াসিন বলেন, “মন্দিরের গায়ে আঁচড় দেখে বুকটা খানখান হয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম নিজেদের সংস্কৃতিকে কেন নষ্ট করছে, বুঝি না। বারণ করলে কটূকথা শুনতে হয়।”
মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে সদর ব্লকের গ্রাম পাথরা। এখানকার মন্দিরগুলি অষ্টাদশ শতকের, বাংলার সুবেদার আলিবর্দি খাঁর সমসাময়িক। পাথরার তত্কালীন নায়েব রাঘবরাম ঘোষালের উত্তরসূরি জমিদাররা বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাথরায়। এখন মাত্র ৮টি মন্দিরে বিগ্রহ রয়েছে। সেগুলিতে জমিদার বংশের শরিকদের উদ্যোগে নিত্যপুজো হয়। বাকি ২৫টি মন্দিরে বিগ্রহ নেই। সেগুলিই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
ইয়াসিনের বহু লড়াইয়ের ফসল হিসেবেই ২০০৩ সালে পাথরার ৩৪টি মন্দির ও সংলগ্ন ২৫ বিঘা পতিত জমি অধিগ্রহণ করে এএসআই। কাছারি বাড়ি-সহ ১৯টি মন্দির সংস্কার হলেও জমির মালিকদের বাধায় পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণের কাজ তিন বছর থমকে। তবে এএসআইয়ের একজন কেয়ারটেকার মেদিনীপুর থেকে গিয়ে মন্দিরগুলি দেখাশোনা করেন। তবে তা যথেষ্ট নয়। বিকেলের পর থেকে প্রতিটি মন্দির ও সৌধ অরক্ষিত পড়ে থাকে। চলে অসামাজিক কাজ। স্থানীয় বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত সামন্তরা বলেন, ‘‘সংস্কারের পরেও মন্দিরগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নজরদারিতে আরও কর্মী দরকার।”
কর্মীর অভাব মানছেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (কলকাতা চক্র) আধিকারিক গৌতম হালদারও। তবে তাঁর মতে, “নজরদারি বাড়িয়ে বিকৃত মানসিকতা বদলানো যায় না। যাঁরা এ সব করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত এই সব স্থাপত্য দেশের সম্পদ।’’ পাথরার বিষয়টি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপেরও আশ্বাস দেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy