পুকুরের পরিচর্যায় সাহেব। নিজস্ব চিত্র
জন্ম সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে। জল আর জঙ্গলের সেই পরিবেশে ছোট থেকেই তাঁর সম্বল হয়েছিল ভিক্ষার ঝুলি। ছোট্ট বেলার সেই দরিদ্র শিশু সাহেব আলি খান বর্তমানে শিল্প শহর হলদিয়া তথা পূর্ব মেদিনীপুরে জেলার বিজ্ঞান আন্দোলনের পরিচতি মুখ।
এক সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে একটা সময় সুন্দরবন থেকে হলদিয়ায় চলে এসেছিলেন সাহেব। অর্থের অভাবে নবম শ্রেণির পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা। তবে থেমে থাকেননি সাহেব। নব্বইয়ের দশকে হলদিয়ায় বিজ্ঞান পরিষদের তৎকালীন সম্পাদক আশিস লাহিড়ীর সান্নিধ্যে আসেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনি বিজ্ঞান কর্মী ইরা ভট্টাচার্য, তাপস কর্মকারদের সাথে ‘এডস’ সংক্রান্ত প্রচারে টানা ১২ বছর কাজ করেন। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে কাজ করেন।
এর মধ্যেই নাট্যশিক্ষক শিশির সেনের নাট্য কর্মশালায় নাটকও শিখতে শুরু করেন সাহেব। বর্তমানে ‘বিজ্ঞান সমাজ চিত্র’ পত্রিকার সম্পাদক সাহেব বিজ্ঞান মঞ্চের হলদিয়া শহর জোনের সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। কলকাতার বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। সাহেব বর্তমানে হলদিয়ার উদ্বাস্তু কলোনিতে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন। বন্দরে অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু এর ফাঁকেই তিনি পরিবেশ দূষণ রোধ এবং বিজ্ঞান মনস্কতা বাড়াতে কাজ করেন। কলম ধরেন এডস, পোলিও, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞান মঞ্চের জল জাঠাতেও যোগ দেন।
শীর্ণকায় বছর চল্লিশের সাহেব বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের স্পর্শেই আমার চেতনা ফিরেছে। তাই আমি আজ অন্য মানুষ। আমাদের এলাকায় একাধিক পুকুর রয়েছে, তাকে দূষণ মুক্ত করতে নিজেই পুকুরে নেমে পড়ি।’’ সেই কাজ করতে গিয়ে বছর চারেক আগে বিষাক্ত সাপের ছোবল খেয়েছেন সাহেব। ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে। তবুও নাছোড়বান্দা সাহেব।
বছর খানেক আগে স্বামী-স্ত্রী বজ্রপাতে মারাত্মক জখম হন। তাঁদের বাড়িতেই বজ্রপাত হয়েছিল। বাড়ির একটি বড় অংশ পুড়ে গিয়েছিল সেবার। দীর্ঘদিন সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী আসমা বিবি চলৎশক্তিহীন এবং শোনার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। পরে দুজনেই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সাহেবকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন বিজ্ঞান পরিষদের বর্তমান সভাপতি তথা ইন্ডিয়ান অয়েলের কর্মী রায়পদ কর। রায়পদবাবু বলেন, ‘‘দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে একজনের জীবন কী ভাবে বদলে যেতে পারে, তাঁর উদারহণ সাহেব।’’ সাহেবকে সম্পদ বলে মনে করেন বিজ্ঞান মঞ্চের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সহ-সম্পাদিকা সুচিস্মিতা মিশ্রও। আর সাহেবের স্ত্রী আসমার কথায়, ‘‘বিজ্ঞানই ওঁর একমাত্র ভালবাসা।’’
বজ্রপাতের পরে সুস্থ হয়েই যুক্তিবাদী প্রচারে বেরিয়ে পড়েছেন সাহেব। তবে সময় পেলে এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের পড়ান। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। ছেলেমেয়েরা হ্যারিকেন নিয়েই তাঁর বাড়িতে আসে। বন্দরের ধুলো মেখে আসা শ্রমিক সাহেবকে ঘিরে তখন হ্যারিকেনের আলোর বৃত্তে মন দিয়ে পড়ে খুদে পড়ুয়ারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy