মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি হাতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সুগত সরকার। নিজস্ব চিত্র।
মেদিনীপুরের বাসিন্দা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সুগত সরকার বেড়াতে গিয়েছিল দক্ষিণ ভারত। বিশাখাপত্তনমে গিয়ে ওইটুকু ছেলে অবাক হয়ে গিয়েছিল— রাস্তাঘাটে গাড়ি চলে কত নিঃশব্দে। চারদিকের প্রকৃতিতে কোনও প্রভাব পড়ে না তীব্র হর্নের।
ছোট্ট ছেলেটি বাড়ি ফিরে সাহস করে একটা চিঠি লিখে ফেলেছিল, পিসিমণি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে— বিশাখাপত্তনমে যদি এয়ার হর্ন বন্ধ হতে পারে,তবে এ রাজ্যে কেন নয়? সালটা ২০১২। সে বছরই সুগতর বাবা সঞ্জয় সরকার হঠাৎ একদিন বাড়ির দরজায় পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধিকে। তিনি নিয়ে এসেছিলেন একটি শংসাপত্র। যেখানে সুগতকে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছিলেন, ‘তোমার পরিবেশ সচেতনতা প্রশংসনীয়।’
সেই শংসাপত্র বাড়িতে সাজিয়ে রেখেছে সুগত। কিন্তু মন থেকে আফশোস যায়নি। কারণ, চতুর্থ শ্রেণির সুগত এখন কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি। যে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে সে চিঠি লিখেছিল, তিনি শপথ নিয়েছেন দ্বিতীয় দফায়। কিন্তু চিঠির উত্তর যত সহজে এসেছিল, দাবি পূরণ হচ্ছে না তত সহজে। সুগতর কথায়, “শহরের মধ্যে, এমনকী স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও বাসগুলি জোরে এয়ার হর্ন বাজিয়ে যায়। পড়াশোনা করতে অসুবিধা হয়। শহরের স্কুলগুলির বেশিরভাগই তো রাস্তার ধারে।”
এই সমস্যা শুধু স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের নয়, নয় মেদিনীপুর, খড়্গপুর, ঘাটাল, ঝাড়গ্রামের মতো শহরাঞ্চলের। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম— যে দিকেই পথ গিয়েছে, যানবাহনের সংখ্যা বে়ড়েছে সেখানেই এয়ার হর্নের তাণ্ডবে জেরবার সাধারণ মানুষ। যোগাযোগের সুবিধের জন্যই রাস্তার ধারে গড়ে ওঠে স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা সরকারি অফিস-আদালত। থাকে বসতিও। প্রশাসন এই সব এলাকায় তাদের দায় সারে শুধু সাইনবোর্ড লিখে। গাড়ির গতিবেগ কম করা বা এয়ার হর্ন নিষিদ্ধ করার জন্য সেটুকু যে যথেষ্ট নয়,তা বলাই বাহুল্য। হাসপাতালে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েও রেহাই নেই জোরাল হর্ন থেকে।
ট্রাফিক সিগনালে আটকে থাকা গাড়িও অযথা হর্ন দিয়ে চলে। কেন এয়ার হর্ন আজও নিষিদ্ধ করা যায়নি?
কেশপুর বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহম্মদ রফিক বলেন, “শহরে, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতির সামনে এয়ার হর্ন বাজাতে আমরাও নিষেধ করেছি।’’ যদিও তাঁর দাবি, মানুষের সচেতনতার অভাবেও হর্ন বাজাতে বাধ্য হন চালকরা। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো বা রাস্তা পার হওয়ার জেরে হর্ন না বাজিয়ে উপায় থাকে না। জেলা পরিবহণ আধিকারিক এস আব্বাস অবশ্য বলেন, “শব্দ দূষণ করা যাবে না। এই বিষয়টি নিয়ে শীঘ্রই কী আইনি পদক্ষেপ করা যায় তা দেখব।’’
শহরের প্রায় সমস্ত রাস্তাতেই ৫-৭ মিনিট অন্তর বাস মেলে। তেমনি বেড়েছে পণ্যবাহী লরির সংখ্যাও। পাল্লা দিয়ে বাড়েছে অটো, টোটো বা ব্যক্তিগত চারচাকা। রাস্তা এক মুহূর্তও ফাঁকা নেই। সকলেই আবার চান অন্যের আগে যেতে। তার জেরে স্কুলের ছাত্রছাত্রী, অসুস্থ রোগী থেকে সাধারণ মানুষ— সকলকেই চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে হয়। মেদিনীপুর শহরের কর্নেলগোলার বাসিন্দা শঙ্কর পালের কথায়, “সব থেকে সমস্যা হয় সদ্যোজাতদের। হর্নের চোটে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওরা।’’
কিন্তু সে কথা শোনে কে? হেলদোল নেই প্রশাসনের। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রটির চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছিল বটে। কিন্তু উপকার হল কই! তবু সুগত এখনও আশা করে, একদিন হয়তো তেমনই হবে, যেমনটা সে চেয়েছিল। তাই আজও সাজানো আছে মুখ্যমন্ত্রীর জবাবখানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy