Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভাতায় টান, স্কুলেও

স্কুলে গেলে পয়সা পেত সেলিমের মতো পড়ুয়ারা। মাসে চারশো টাকা। কিন্তু আপাতত সে অর্থসাহায্য থেকে বঞ্চিত সেলিম এবং তার মতো আরও অনেকে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পড়া ছেড়ে পয়সা রোজগারে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে বিপজ্জনক পেশা। 

স্কুলে শিশু শ্রমিকেরা। নিজস্ব চিত্র

স্কুলে শিশু শ্রমিকেরা। নিজস্ব চিত্র

গোপাল পাত্র ও আনন্দ মণ্ডল
এগরা ও তমলুক শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

কাগজ কুড়িয়ে পয়সা হয়। স্কুলে তো শুধু পড়া। আগে তা-ও স্কুলে গেলে পয়সা মিলত। ইদানীং আর তা-ও মিলছে না।

রেগে অগ্নিশর্মা শেখ সেলিম। তাই স্কুল ছেড়ে সে আবার ফিরেছিল পুরনো কাজে। খবর পেয়ে শিক্ষিকারা গত শুক্রবার ফের স্কুল ফিরিয়ে এনেছেন। এগরার কসবা গ্রামের শেখ সেলিম পড়াশোনা করে শিশু শ্রমিক স্কুলে। পড়াশোনা করলেও তাতে মন নেই সেলিমের। তার কথায়, ‘‘পয়সা না পেলে চলবে কী ভাবে।’’

স্কুলে গেলে পয়সা পেত সেলিমের মতো পড়ুয়ারা। মাসে চারশো টাকা। কিন্তু আপাতত সে অর্থসাহায্য থেকে বঞ্চিত সেলিম এবং তার মতো আরও অনেকে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পড়া ছেড়ে পয়সা রোজগারে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে বিপজ্জনক পেশা।

অথচ হওয়ার কথা ছিল ঠিক এর উল্টোটাই। শিশু শ্রমিক বন্ধ করে তাদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসতে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রজেক্ট’ রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে শিশু শ্রমিক স্কুল। সেখানে শিশু শ্রমিকেরা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পায়। মিড ডে মিল তো রয়েইছে। স্কুলে এলে শিশু শ্রমিকরা পায় মাসিক ভাতা। গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তিরিশটি শিশু শ্রমিক স্কুল রয়েছে। শুধুমাত্র এগরা মহকুমায় রয়েছে ৭টি স্কুল। জেলার স্কুলগুলিতে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ১১৩০। সূত্রের খবর, ওই স্কুলগুলিতে পড়ুয়ারা গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ভাতা পাচ্ছে না।

আগে কেন্দ্র সরকার সরাসরি স্কুলে টাকা পাঠাত। ২০১৫ সালে থেকে নিয়ম হয়, পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। সমস্যা এখানেই। ‘ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রজেক্ট’-র পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রকল্প আধিকারিক অর্ণব সিংহচৌধুরী জানান, যতজন পড়ুয়া রয়েছে তার একজনেরও যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনও সমস্যা থাকে তা হলে কেউই ভাতার টাকা পাবে না। ন’বছর থেকে ১৪ বছর বয়সি পড়ুয়ারা এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাঙ্কগুলি ১০ বছরের কম বয়সিদের অ্যাকাউন্ট খুলতে আগ্রহী হয় না। সমস্যা আরও রয়েছে। পড়ুয়াদের ভাতার টাকা আসে বছরে দু’বার। তাই অনেকসময় বছরে মাত্র দু’বার লেনদেন হওয়ায় কিছু অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে দেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। এমন ঘটনা একজনের সঙ্গে ঘটলেই আটকে যায় সকলের টাকা।

অর্ণব মানছেন, ভাতার টাকা নিয়মিত ভাবে পাচ্ছে না পড়ুয়ারা। ২০১৫ সালে নতুন নিয়ম চালু হলেও ওই আর্থিক বছরে টাকা পায়নি পড়ুয়ারা। তারপর ২০১৬, ২০১৭ সালে টাকা মিলেছিল। কিন্তু ২০১৮ এবং চলতি বছরের প্রথমার্ধের টাকা মেলেনি। তা হলে উপায়? অর্ণবের কথায়, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সমস্যা জানিয়েছি। অ্যাকাউন্ট সচল রাখতে ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। অভিভাবকদেরও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে।’’

ভাতার টাকা পেলে পরিবারের কিছুটা সুবিধা হবে। ফলে শিশু শ্রমিকেরা স্কুলে পড়াশোনা করতে পারবে— মূলত এই ভাবনা থেকেই ভাতা দেওয়া হয় ওই স্কুলের পড়ুয়াদের। ভাতা বন্ধ হলে আসল উদ্দেশ্যই তো ব্যর্থ! কসবার ওই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আকাশ মাইতি এবং রোহিত পয়ড়্যার কথায়, ‘‘দিদিমণিরা ভাল করে পড়াশোনা করান। অনেকদিন স্কুল থেকে টাকা দেয় না। জানি না বাড়ির লোকেরা আর কতদিন স্কুলে আসতে দেবে।’’ কেন আসছে না ভাতার টাকা? স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা এবং জেলা ফেডারেশনের সম্পাদিকা বনানী দাস মহাপাত্রের কথায়, ‘‘ ছাত্রছাত্রীদের যাবতীয় কাগজপত্র জেলাশাসকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও কোথায় সেই কাজ আটকে রয়েছে।’’

ভাতার টাকায় তো শুধু আর ডাল, ভাত হয় না। মাঝে মাঝে অন্য কিছুও হয়। পুজোর সময় নতুন জামা কাপড় সেই টাকাতেই হত। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে তা হচ্ছে না। আকাশ ও রোহিতের কথায়, ‘‘ভাল জামা নেই। এ বারও পুজোয় আমাদের নতুন জামা হবে না।’’

সেলিমকে স্কুলে ফিরিয়ে এনেছেন শিক্ষিকারা। দীর্ঘদিন ভাতা না পেলে আকাশ, রোহিতরা স্কুলে থাকবে তো! চিন্তায় ঘুম উড়েছে শিক্ষকদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Labour Tamluk Egra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE