শহরে শিক্ষকদের মিছিল
ইতিমধ্যেই কলকাতায় শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলন। এই ‘বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন’-এ বহু টাকার বিনিয়োগেরও দাবি করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাস্তবে অবশ্য জেলায় জেলায় শিল্পের ছবিটা আদৌ সুখকর নয়। নতুন বিনিয়োগ আসছে না। উল্টে গত কয়েক বছরে একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু দিন আগেই জেলা সফরে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনিও কোনও শিল্প-বার্তা দিয়ে যাননি।
গত ডিসেম্বরে খড়্গপুর শিল্পতালুকেই কর্মিসভা করে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে আশায় বুক বেঁধেছিলেন বন্ধ কারখানার শ্রমিকেরা। সেই আশা আচমকাই বদলে গিয়েছে দুরাশায়। এই যেমন উজ্জ্বল মল্লিক এবং বিকাশ দাস। এক জন থাকেন খড়্গপুরে, অন্য জন মেদিনীপুরে। দু’জনের কারখানাই এখন বন্ধ। উজ্জ্বলবাবু কাজ করতেন খড়্গপুরের রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগে। কারখানাটি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ। বিকাশবাবু কাজ করতেন মেদিনীপুরের কেশর মাল্টিয়ার্ন মিলে। কারখানাটি প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ।
উজ্জ্বলবাবু বলেন, “বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। মোট পাঁচজনের সংসার। কী ভাবে সংসার চলছে বলে বোঝাতে পারব না।” তাঁর কথায়, “মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা মাইনে পেতাম। কারখানা বন্ধের পর ঠিক শ্রমিকের কাজ করি। সব দিন কাজ পাই না। কোনও রকমে দিন কাটছে এই যা। জেলায় এসে মুখ্যমন্ত্রী শিল্প নিয়ে কিছু না বলায় সত্যিই আমরা হতাশ।”
পালাবদলের পরে এই জেলায় নতুন কারখানা তো সেই ভাবে হয়নি। শালবনিতে জিন্দলের প্রস্তাবিত ইস্পাত প্রকল্প ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি তা-ও স্থগিত হয়ে গিয়েছে। জিন্দলরা রায়তি জমি ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। জমিদাতাদের অবশ্য বক্তব্য, জমি নয়, তাঁরা কারখানাই চান। এই মর্মে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনাকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন তাঁরা। জমিদাতা সংগঠনের সম্পাদক পরিষ্কার মাহাতো বলেন, “আমরা জমি ফেরত চাই না। কারখানাই চাই। এই দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলবে।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় এলে তাঁর সঙ্গেও দেখা করে এই দাবি জানাতে চান জমিদাতারা।
খড়্গপুরে বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকেও বহু জমি পড়ে রয়েছে। শিল্পের দেখা নেই। সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসির জেলা সম্পাদক বিপ্লব ভট্টের দাবি, “খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে ১,২৪৯ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০৫ একর জমি ব্যবহৃত হয়েছে। বাকি ৯৪৪ এক জমি ফাঁকা পড়েই রয়েছে। বাম-আমলে সরকার এখানে জমি অধিগ্রহণ করেছিল শিল্পের জন্য। তৃণমূল সরকারের শিল্প গড়ার কোনও উদ্যোগই নেই।” তাঁর কথায়, “গত সাড়ে তিন বছরে জেলায় নতুন শিল্পের প্রসার প্রায় বন্ধ। রাজ্য সরকারের সঠিক উদ্যোগের অভাবেই শিল্প-পুঁজি অন্য রাজ্যে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।” গোয়ালতোড়ে প্রস্তাবিত শিল্পতালুকের কাজও বিশেষ এগোয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে বিঁধতে ছাড়ছে না বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলছেন, “রাজ্য সরকারের শিল্পনীতি ও উদ্যোগহীনতা পশ্চিমবঙ্গকে বিশিল্পায়নের পথে নিয়ে চলেছে।” কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়ার বক্তব্য, “গত সাড়ে তিন বছরে বহু চালু কারখানা বন্ধ হয়েছে। নতুন কারখানাও সেই ভাবে হচ্ছে না। অথচ কখনও বলা হচ্ছে তিন লক্ষ চাকরি হয়ে গিয়েছে। কখনও বলা হচ্ছে, ছ’লক্ষ চাকরি হয়ে গিয়েছে। এ সবই ভাঁওতা।”
বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়ের মতে, “লগ্নি টানতে রাজ্য যতই এ দিক-ও দিক দৌড়ক না কেন, লগ্নিকারীদের মানচিত্রে পশ্চিমবাংলা ব্রাত্য! এর প্রধান কারণ রাজ্যের শিল্পনীতি। যে সব কারখানা আছে, সেগুলি সিন্ডিকেট থেকে তোলাবাজি, নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ সব অভিযোগও তৃণমূলের দিকে।” তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই সব অভিযোগ মানতে নারাজ। দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের পাল্টা প্রশ্ন, “কে বলছেন নতুন কারখানা হচ্ছে না? নতুন চাকরি হচ্ছে না? রাজ্য আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছে। তা-ও উন্নয়ন, কর্মসংস্থান হচ্ছে।” তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি তথা জেলা পরিকল্পনা কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান প্রদ্যোৎ ঘোষের আবার দাবি, “যে সব কারখানা বন্ধ হয়েছে, সেই সব কারখানা বন্ধের পরিস্থিতি বাম-আমলেই তৈরি হয়েছিল! রাজ্য সরকার বন্ধ কারখানাগুলো খোলার সব রকম চেষ্টা করছে।”
শাসক দলের নেতারা যা-ই বলুন না কেন বাস্তব হল রাজ্যে কাজের সুযোগ কমছে। পড়ার পাট চুকিয়ে চাকরির সন্ধানে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতাও তাই বাড়ছে। কর্মসংস্থানের হিসেবে অসম, সিকিম, গুজরাতের মতো রাজ্য যেখানে এগিয়ে চলেছে, সেখানে পিছিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। তার উপর রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলার সমস্যায় শঙ্কিত লগ্নিকারীরা। রাজ্যের জমি-নীতিও শিল্পহীনতার আর একটি কারণ। এই পরিস্থিতিতে দানা বাঁধছে শ্রমিক অসন্তোষ। বিশেষ করে বন্ধ কারখানায়। সম্প্রতি মেদিনীপুরের কেশর মাল্টিয়ার্ন মিলের জমি বাঁশ পুঁতে দখলের চেষ্টা করেন বন্ধ এই কারখানারই কিছু শ্রমিক। কারখানা খোলার দাবিতে পথে নেমেছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত শ্রমিক ইউনিয়নও। মেদিনীপুরের আইএনটিটিইউসি নেতা শশধর পলমল বলেন, “এক বছর হতে চলল কারখানা বন্ধ। শ্রমিকদের অসন্তোষ স্বাভাবিক। আমরাও চাই দ্রুত কারখানা খুলুক।”
কিন্তু খোদ মুখ্যমন্ত্রী তো জেলায় এসে শিল্পের কোনও বার্তা দিয়ে গেলেন না। শ্রমিকরা তাই হতাশ। খড়্গপুরের বন্ধ কারখানার এক শ্রমিকের কথায়, “যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু কি আর কাঠের শিল্প, সিমেন্টের শিল্প, লোহার শিল্পই শিল্প?’ যিনি দূর করে দেন, শিল্প-বাণিজ্য আর কলাশিল্পের ভেদাভেদ, তাঁর রাজ্যে শিল্প আসবে কী করে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy