Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সেতু-রাস্তায় সাজলেও হয়নি বাসস্ট্যান্ড, যানজটে দুর্ভোগ

এলাকায় পরিবহণের প্রধান মাধ্যম বাস। অথচ কোনও বাসস্ট্যান্ড নেই। রাস্তা পিচ অথবা কংক্রিটের হয়েছে। কিন্তু পথবাতি নেই। সন্ধে নামলেই চারদিক আঁধার। বাজার ও বসতি এলাকায় নেই ভ্যাট। যত্রতত্র আবর্জনা জমে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ভোগান্তি হয় যাতায়াতে। জঙ্গলমহল-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র লালগড়ে নাগরিক পরিষেবার ছবিটা এমনই।

বাসস্ট্যান্ড নেই। ব্যস্ত এসআই চকে রাস্তার মধ্যেই চলছে যাত্রীদের ওঠানামা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

বাসস্ট্যান্ড নেই। ব্যস্ত এসআই চকে রাস্তার মধ্যেই চলছে যাত্রীদের ওঠানামা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

কিংশুক গুপ্ত
লালগড় শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৩
Share: Save:

এলাকায় পরিবহণের প্রধান মাধ্যম বাস। অথচ কোনও বাসস্ট্যান্ড নেই।

রাস্তা পিচ অথবা কংক্রিটের হয়েছে। কিন্তু পথবাতি নেই। সন্ধে নামলেই চারদিক আঁধার।

বাজার ও বসতি এলাকায় নেই ভ্যাট। যত্রতত্র আবর্জনা জমে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ভোগান্তি হয় যাতায়াতে।

জঙ্গলমহল-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র লালগড়ে নাগরিক পরিষেবার ছবিটা এমনই। অথচ ২০০৯-১০ সালে মাওবাদী নাশকতা-পর্বে শিরোনামে উঠে আসা এই জনপদে পালাবদলের পরে উন্নয়নের বেশ কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে কলেজ ও মডেল স্কুল। বহুতল নার্সিং ট্রেনিং কলেজ তৈরির কাজ চলছে। ঝাড়গ্রামের সঙ্গে সহজে যোগাযোগের জন্য আমকলা ঘাটে সেতু তৈরির কাজ চলছে জোর কদমে। লালগড়ের খানিকটা বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটেছে বটে, কিন্তু নাগরিক পরিষেবার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

শুধু মাওবাদী অনুষঙ্গে শিরোনামে উঠে আসা নয়, কংসাবতীর কুলঘেষা লালগড়ের ইতিহাসও যথেষ্ট প্রাচীন। জানা যাচ্ছে, ১৫৯২ সালে বাংলার তৎকালীন সুবাদার নাসির খান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাঁকে শায়েস্তা করতে ওড়িশা থেকে আসেন মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ। মেদিনীপুরের কাছে তুমুল যুদ্ধে নাসিরকে পরাস্ত করেন তিনি। ওই যুদ্ধে মানসিংহের পক্ষের যোদ্ধা লাল সিংহ অসম্ভব বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মান সিংহকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন আদতে উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার বাসিন্দা লাল সিংহ। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে মান সিংহ বাংলার সুবাদার হওয়ার পরে কংসাবতীর তীর লাগোয়া এক বিস্তীর্ণ জঙ্গলখণ্ডের দায়িত্ব পান লাল সিংহ। শাঁখাখুল্যায় তৈরি হয় গড়-প্রাসাদ। প্রথম রাজার নামানুসারেই এলাকার নাম হয় লালগড়। পরে অবশ্য নদীভাঙনের জেরে শাঁখাখুল্যায় পুরনো গড় ও প্রাসাদ তলিয়ে যায় কংসাবতীর গর্ভে। সেখান থেকে কিছুটা উত্তরে উঁচু এলাকায় তৈরি হয় পরবর্তী রাজাদের খাসতালুক। লাল সিংহের উত্তরসূরিরা ‘সাহস রায়’ উপাধিতে ভূষিত হন।

রাজরাজড়ার আমল আর নেই। প্রাচীন এই জনপদ লালগড়ও এখন বদলে গিয়েছে। এলাকার অধিকাংশ রাস্তা এখন পিচ কিংবা কংক্রিটের হয়েছে। অথচ রাস্তার দু’পাশে সুষ্ঠু নিকাশির ব্যবস্থা করা হয়নি। এলাকার নিকাশিও বেহাল। রাজবাড়ির পাশে একটি নতুন পাকা নর্দমা তৈরির কাজ চলছে। কিন্তু পুরনো নালাগুলি জঞ্জালে ভর্তি। জঞ্জাল পরিষ্কারের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় লালগড়ের সৌন্দর্যহানি ঘটছে বলে অভিযোগ। বাজার এলাকা ও লোকালয়ে নেই ভ্যাট। বাবুপাড়া, আখড়াগোড়া, বাজার পাড়া, বাঘাকুলির মতো জনবহুল পাড়াগুলিতেও জঞ্জাল ফেলার নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলেন বাসিন্দারা। নিকাশির অভাবে ভারী বৃষ্টি হলেই নিচু এলাকাগুলিতে জল জমে যায়। লালগড়ের ব্রাহ্মণপল্লির বাসিন্দা পেশায় মেদিনীপুর কলেজের কর্মী অমিয় রায় বলেন, “উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। নিয়মিত জঞ্জাল সাফাইয়ের বন্দোবস্ত করাও দরকার।” সত্তরোর্ধ্ব খাঁদি চালক বলেন, “রাস্তায় পথবাতি নেই। রাতে প্রাণ হাতে করে হাঁটাচলা করতে হয়।”

লালগড়ে কোনও বাসস্ট্যান্ড না থাকাতেও নিত্য সমস্যায় পড়তে হয় বাসিন্দাদের। স্থানীয় ব্যবসায়ী বেণুধর চক্রবর্তী বলেন, “দিনে কুড়ি জোড়া বাস চলেন। অথচ এখানে কোনও যাত্রী প্রতীক্ষালয় নেই। শৌচাগারও নেই।” এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসস্ট্যান্ড না থাকায় লালগড়ের এসআই চক কিংবা লাইব্রেরি চকের মতো জনবহুল রাস্তায় যত্রতত্র বাসগুলি দাঁড়িয়ে যায়। সমস্যায় পড়েন পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। লালগড় থেকে কাছেপিঠে যাতায়াতের জন্য রিকশা কিংবা অটোর ব্যবস্থাও নেই। ফলে, বাইরে থেকে আসা লোকজন যেমন সমস্যায় পড়েন, তেমনই এলাকার ছাত্রছাত্রীদেরও সমস্যা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা বুদ্ধদেব পালের কথায়, “প্রশাসনের উদ্যোগে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়ে যদি অটো চালানোর বন্দোবস্ত করা হয়, তাহলে বিকল্প কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে।” লালগড়ের হাটচালা বাজারটি অপরিসর। সেখানে স্থায়ী কোনও শেড নেই। ফলে, বুধবার সাপ্তাহিক হাটের দিনে কার্যত রাস্তা ঘিরেই দোকান-বাজার বসে যায়। তখন লালগড়-নেতাই রাস্তায় যানবাহন চলাচলে ভীষণই সমস্যা হয়।

রাস্তার ধারে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের টাইম কল থেকে দু’বেলা পানীয় জল পাওয়া যায়। কিন্তু লালগড়কে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনও মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়নি। পুরসভা ঘোষণার দাবিটিও উপেক্ষিত। লালগড় রামকৃষ্ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শঙ্করচন্দ্র পালের কথায়, “এক সময় লালগড় অশান্ত হয়েছিল বলেই তো এখন জঙ্গলমহলে এত উন্নয়নের আয়োজন। সে ক্ষেত্রে লালগড়কে পুরসভা ঘোষণা করে উপযুক্ত নাগরিক পরিষেবার দাবিটি মোটেই অযৌক্তিক নয়।”

লালগড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কৃষ্ণগোপাল রায় অবশ্য জানান, লালগড়কে পুরসভা করার ব্যাপারে তাঁদের কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, এলাকায় পরিষেবামূলক নানা কাজ হয়েছে। যেমন, লালগড়ের রাস্তাঘাট কংক্রিটের করা হয়েছে। রাস্তার টাইম কলে পর্যাপ্ত পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে। নিকাশি-সহ অন্য পরিষেবার মানোন্নয়নে চেষ্টা চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE