বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
মির্জাপুর গ্রামে আশ্বিনের সন্ধ্যা নামত একটু অন্য ভাবে। অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অখ্যাত সেই গ্রামে সকাল বেলাতেই গ্রামের সবার ‘যোগ দিদা’ ফরমান জারি করে দিতেন, “আজ দুপুরে পাক হবে।” স্নানের ঘাট থেকে মুখে মুখে সে খবর ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি অন্দরমহলে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করে হেঁসেল গুছিয়ে, দু’দণ্ড জিরিয়ে পাড়ার বউরা সবাই হাজির হতেন যোগ দিদা ওরফে যোগমায়া দেবীর উঠোনে। সেখানেই ঠিক হত, আজ কার বাড়ির ‘পাক’ হবে। পাক শুরু হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আশ্বিনের হিম সন্ধ্যায় জ্বলে উঠত হ্যারিকেন, কুপি, লম্ফ। অন্ধকারে ঘেরা সেই উঠোনে স্বল্প আলোয় গোল হয়ে বসে একদল মহিলা তৈরি করে চলেছেন অবিশ্বাস্য সব সুখাদ্য। সুগন্ধে চারপাশ ম ম করছে। আর ঠিক মাঝখানে জলচৌকির উপর মধ্যমণি হয়ে সব কিছু তদারক করছেন দিদা। পাক সারা হতে হতে রাতের প্রথম প্রহর শেষ।
ছোটবেলায় মামাবাড়ির গ্রামের কোজাগরীর প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়ে ষাট বছর আগে পিছিয়ে গিয়েছিলেন নিভাননী দেবী। অর্ধ শতক আগে এভাবেই কোজাগরীতে প্রস্তুত হত বাংলার গ্রাম। যোগমায়া ওরফে যোগদিদা ছিলেন সত্তর পার করা নিভাননী দেবীর দিদিমা। প্রবীণা নাতনির কথায় “দিদিমা যে কত রকমের খাবার করতে জানতেন! মায়ের মুখে শুনেছি বিজয়া, লক্ষীপুজো, পৌষপার্বণ, নবান্ন-যে কোনও উৎসবে গোটা গ্রাম যেন মুখিয়ে থাকত এবারে যোগমায়া কী মায়া দেখাবেন তার জন্য। দিদিমা দুর্গাষষ্ঠীর দিন থেকে পাড়ার বউদের নিজের হাতে শেখাতেন ওইসব হারিয়ে যাওয়া সুখাদ্য তৈরির কায়দা।” যোগ দিদার রান্নাঘরের সামনে ছিল একফালি উঠোন। তাঁর ছিল এক অদ্ভুত নিয়ম। এক একদিন এক এক বাড়ির জন্য পাক হবে। কিন্তু কখনওই এক পদ দুটো বাড়ির জন্য হবে না। নিভাননী দেবীর কথায়, “আমাদের ছোটবেলায় পূর্ববঙ্গের গ্রামদেশে দুর্গাপুজো নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই ছিল বড় উৎসব।”
কোজাগরীর রকমফের ছিল দেখার মতো। কোথাও দুর্গাঠাকুরের সমান বড় প্রতিমা। কোথাও আবার কলাবউ গড়ে পুজো, তো কোথাও সরালক্ষ্মী। মজার ব্যাপার হল লক্ষ্মীসরায় বেশির ভাগ সময়ে আঁকা থাকত রাধাকৃষ্ণ অথবা দুর্গার ছবি। পিছনে দাঁড় করানো বড় কলাগাছের গায়ে নতুন শাড়ি জড়িয়ে তৈরি কলাবউ। তার গোড়ায় লক্ষ্মীসরা আর সবার সামনে ঘট।
কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন কুলপুরোহিতকে কাছ ছাড়া করতেন না হেমবরণী। যশোরের সরকার বাড়ির প্রধানকর্ত্রী আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীর দিন খুব সতর্ক থাকতেন যাতে ‘সঠিক সময়’ হাতছাড়া না হয়ে যায়। চতুর্দশী যত ফুরিয়ে আসত ততই ব্যস্ততা বাড়ত তাঁর। পুরোহিতকে তাড়া দিতেন, “ঠাকুরমশাই, সময় হল?” বাড়ির বউ মেয়েরা শাঁখ নিয়ে তৈরি থাকতেন। পঞ্জিকা হাতে নিয়ে বালিঘড়িতে সময় দেখে পুরোহিত মশাই সঙ্কেত দিতেই একসঙ্গে বেজে উঠত অনেক শাঁখ। নিকানো উঠানে পাতা নতুন কাপড়ের উপর হেমবরণী বের করে আনতেন একটি বিরাট আকারের লক্ষ্মীর ঘট। ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে সারা বছর রাখা থাকত ওই ঘট। বাড়ির মহিলারা বছরভর ওই ঘটে নানা উদ্দেশ্যে পয়সা জমাতেন। কোজাগরী পূর্ণিমা পড়তেই সেই ঘট ভেঙে যে পয়সা পাওয়া যেত তা দিয়ে কেনা হত লক্ষীপুজোর একটি উপকরণ এবং আর একটি মাটির ঘট। যেখানে আবার একবছর ধরে পয়সা জমাবেন বাড়ির মেয়েরা।
স্মৃতি থেকে শ্বশুরবাড়ির কোজাগরীর কথা এমন ভাবে বলছিলেন প্রভাতীদেবী যেন এখনও প্রতিবছর এভাবেই পুজো হয়। পঞ্চান্ন বছর আগে যশোর ছেড়ে এসেছেন নদিয়ায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর কথায় বলেন, “সেই কবে দেশ ছেড়ে এসেছি। কিছুই আনতে পারিনি স্মৃতিটুকু ছাড়া। এখানেও এখন কোজাগরীতে খুব ধুম। খাওয়া দাওয়া, আলো, বাজি পোড়ানো। কিন্তু নেই আলপনা, নেই লক্ষ্মীর ছড়া। ভেটের নাড়ু, ফালার নাড়ু, তক্তি বা নারকেলের সাঁজের নামই জানে না কেউ। ও সব ছাড়া আবার কোজাগরী হয় না কি?” শুধু আলপনা বা ছড়া নয়। সময়ের সঙ্গে পালটে গিয়েছে পুজোর উপকরণও। কলাবউ, ঘট, লক্ষ্মীসরা ছাড়াও ওপার বাংলায় আরও এক রকম ভাবে কোজাগরী পুজো হত। বেতের ছোট চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপর দুটি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হত। একে বলা হত ‘আড়ি লক্ষ্মী’। প্রভাতী দেবীর আক্ষেপ “এখানে সবাই দেখি প্রতিমা এনে পুজো করছে। কোজাগরী যেন নিয়মরক্ষের লক্ষীপুজো হয়ে উঠেছে।” অথচ এমনটা ছিল না। মধ্যযুগে বণিকেরা এই লক্ষ্মীর পুজো করতেন। ঘোর বর্ষার পর প্রসন্ন শরতে জলপথে বাণিজ্যযাত্রার আগে রাতভোর কোজাগরীপুজোর মন্ত্রে তার প্রতিফলন -- নিশীথে বরদে লক্ষ্মী, কোজাগর্তী মহীতলে। সারারাত জেগে প্রদীপ জ্বেলে পুজো দিয়ে, ভোগ নিবেদন করে তাঁকে প্রসন্ন করার চেষ্টা এই পুজো। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “অবিভক্ত বাংলার একেবারে নিজস্ব কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর অনেক কিছুই নেই। নেই মানুষগুলো, সময়টাও আমূল বদলে গিয়েছে। সেই মাটির উঠোন, ধানের বিনুনি করা গোছা কোথায়। আলপনার স্টিকার পর্যন্ত দোকানে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। মৈমনসিংহ গীতিকার মতো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্মীপুজোর উল্লেখ দেখে বোঝা যায় সেকালে এই পুজোর জনপ্রিয়তা কতটা ছিল।”
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর “বাঙালীর ইতিহাস”-গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। ...আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পুজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা...। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পুজা আজও অব্যাহত। ...বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy