Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সামরিক শহরের স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠেছে কল্যাণী

সময়ের সঙ্গেই বদলে যায় প্রকৃতি, মানুষ এবং জনপদ। ‘চাঁদমারি হল্ট’ থেকে সামরিক শহর ‘রুজভেল্ট নগর’ আর তারপরে শান্ত সাজানো জনপদ কল্যাণীও সেই বদলে যাওয়ার গল্প বলে। কল-কারখানার শিল্পের দিক থেকে খুব একটা সাবলম্বী হতে না পারলেও সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনা কল্যাণীর মানুষকে মাতিয়ে রাখে বছরভর ছবির প্রদর্শনী, নাটক, বইমেলা, বঙ্গ সংস্কৃতি, হস্তশিল্প মেলা কী নেই এই শহরে!

তখনও পুরসভা হয়নি।—নিজস্ব চিত্র।

তখনও পুরসভা হয়নি।—নিজস্ব চিত্র।

বিতান ভট্টাচার্য ও সৌমিত্র সিকদার
কল্যাণী শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:২৯
Share: Save:

সময়ের সঙ্গেই বদলে যায় প্রকৃতি, মানুষ এবং জনপদ। ‘চাঁদমারি হল্ট’ থেকে সামরিক শহর ‘রুজভেল্ট নগর’ আর তারপরে শান্ত সাজানো জনপদ কল্যাণীও সেই বদলে যাওয়ার গল্প বলে। কল-কারখানার শিল্পের দিক থেকে খুব একটা সাবলম্বী হতে না পারলেও সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনা কল্যাণীর মানুষকে মাতিয়ে রাখে বছরভর ছবির প্রদর্শনী, নাটক, বইমেলা, বঙ্গ সংস্কৃতি, হস্তশিল্প মেলা কী নেই এই শহরে!

এক সময়ে রেল স্টেশনের ফলকে লেখা থাকত ‘চাঁদমারি হল্ট’। পরে তারও নামকরণ হয় কল্যাণী। পরাধীন ভারতের সামরিক উপনিবেশ হিসাবে গঙ্গার ধারে নদিয়ার ৪৫টি গ্রাম নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট নিজের নামেই ‘রুজভেল্ট নগর’-এর গোড়াপত্তন করেছিলেন। মূলত বিশ্বযুদ্ধের কথা মাথায় রেখেই এই সামরিক শহরের জন্ম হয়েছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন কোহিমায় জাতীয় পতাকা তুলেছেন। ইম্ফলের দখলও নিয়েছে আজাদ হিন্দ বাহিনী।

১৯৪৪ সালের মে মাসে বিশ্বযুদ্ধে হার মেনে জার্মানি মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরমাণু বোমার আঘাত সহ্য করতে না পেরে জাপানও পরাজয় বরণ করে। বিশ্বযুদ্ধ থামলে আমেরিকান সেনা বাহিনীর রুজভেল্ট নগরের প্রয়োজন মিটে যায়। তাই শেষমেশ মার্কিন সেনারাও এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। জনমানবহীন সামরিক শহর এক সময়ে পরিত্যক্ত জনপদের চেহারা নেয়। যুদ্ধের বহু নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল শহর জুড়ে। কিন্তু ইতিহাসের চিহ্ন বুকে নিয়ে রুজভেল্ট নগর তখন ক্রমে জঙ্গলে ঢাকছিল।

রুজভেল্টের সামরিক শহরকে নব কলেবরে সাজিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। ডাক্তার নীলরতন সরকারের মেয়ে কল্যাণীর নামে পরিত্যক্ত সামরিক শহরের নাম হয় কল্যাণী। ১৯৫০ সালে এই শহরের মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়। ১৯৫১ সালে সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই শহরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তত্‌কালীন রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কার্টজু। ১৯৫৪ সালে চাঁদমারি হল্ট স্টেশনের নাম মুছে ফেলা হয়। সেখানে লেখা হয় ‘কল্যাণী’। ১৯৫৪ সালে এই শহরে ৫৯ তম সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল।

ওই বছরেরই ১৯ জানুয়ারি দেশের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কল্যাণীতে এসেছিলেন। ১৯৯৫ সালে ১৭ অক্টোবর কল্যাণী পুরসভা গঠিত হওয়ার পরে উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যেতে শুরু করে। ভারতের প্রথম ‘নির্মল শহর’-এর স্বীকৃতি পায় কল্যাণী। রাজ্যের ৯টি শহরের সঙ্গে এই শহরেও স্মার্ট সিটি’র তকমা লাগছে।

ঝাঁ চকচকে কল্যাণী পুরসভা।—নিজস্ব চিত্র।

শহরের যে পরিবর্তনই হোক না কেন, সে দিনের বহু অভিজ্ঞতা আজও ভোলেননি শহরের প্রবীন নাগরিকেরা। তাঁদের কেউ কেউ জানালেন, এক সময়ে এই শহরের বেশির ভাগটাই ছিল ফাঁকা জলা-জঙ্গল। মাত্র চল্লিশ ভাগ অংশে বসবাস ছিল। বাকি সব প্লট ছিল ফাঁকা। পুরভবনের বিপরীত দিকের ট্র্যাক্টর গ্যারাজ থেকে মেন স্টেশন পর্যন্ত রাস্তা ছিল সুনসান। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোও ছিল না।

বাল্বের টিমটিমে হলুদ আলো সে ভাবে মাটি পর্যন্ত পৌঁছতই না। সন্ধে ৭টার পরে রাস্তায় কাউকে দেখা যেত না। সারা দিনে হয় তো একটা সাইকেল রাস্তায় দেখা গেলেও যেতে পারে, এমনই দশা। এক সময়ে এখানে মাত্র দু’জন ডাক্তার ছিলেন। তাঁদের একজনের ফিজ ছিল দু’টাকা। অন্য জনের ফিজ ছিল চার টাকা। ওষুধের দোকান বলতে কাঁচরাপাড়ার একটি মাত্র দোকান ছিল ভরসা।

প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতের আমলে কল্যাণী শহরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ২৭ নম্বর রুটে দু’একটা বাস চলত সারা দিনে। রাস্তায় অন্য গাড়ি ছিল না বললেই চলে। সাপখোপ, শিয়াল, পাখির ডেরা ছিল নানা জায়গায়। এমনকী, বুনো শুয়োরেরও উত্‌পাত ছিল। শোনা যায়, একবার লেক হোস্টেলের ছাত্ররা একটা চিতা বাঘকে মেরেছিল। পরে সেটি সাইকেলে তুলে গোটা এলাকায় ঘোরানো হয়েছিল।

• দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সামরিক উপনিবেশ হিসাবে গঙ্গার ধারে নদিয়ার ৪৫টি গ্রাম নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট নিজের নামেই ‘রুজভেল্ট নগর’-এর গোড়াপত্তন করেছিলেন।

• রুজভেল্টের সামরিক শহরকে নব কলেবরে সাজিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। ডাক্তার নীলরতন সরকারের মেয়ে কল্যাণীর নামে পরিত্যক্ত সামরিক শহরের নাম হয় কল্যাণী।

• লেক হোস্টেলের ছাত্রেরা এক বার চিতা বাঘকে মেরেছিল। সেটি সাইকেলে ঘোরানো হয়।

লেখক দীপঙ্কর চক্রবর্তী জানালেন, কল্যাণীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সাল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছরের ৭ এপ্রিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে তত্‌কালীন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতে কল্যাণী মেন স্টেশন থেকে কল্যাণী সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথের উদ্বোধন করেন। সেই থেকে শিয়ালদহ-কল্যাণীগামী ‘কল্যাণী লোকাল’ হল ‘কল্যাণী সীমান্ত লোকাল’। কল্যাণী থেকে সরাসরি হুগলি, বর্ধমান, হাওড়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তৈরি হল ঈশ্বরগুপ্ত সেতু। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

১৯৮৯ সালের ৬ অক্টোবর এটির উদ্বোধন করেন তত্‌কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ১৯৫৭ সালে তৈরি হয় কল্যাণী থানা। ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি কল্যাণী, চাকদহ এবং হরিণঘাটা থানা নিয়ে গঠিত হয় কল্যাণী মহকুমা। রবীন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রথম মহকুমাশাসক।

মূল শহরটি দেখতে শুনতে ঝাঁ চকটকে হলেও সমস্যাও প্রচুর। যার অন্যতম হল নিকাশি। কোথায় নালা নেই, কোথায় আবার নালা থাকলেও তা নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। ফলে মশার উপদ্রব বাড়ে। পুর এলাকা হলেও বেশ কিছু জায়গায় এখনও রাস্তায় স্রেফ ইট পাতা। পিচ পড়েনি। নিচু রাস্তাগুলিতে বর্ষায় জল দাঁড়িয়ে সমস্যা হয়। আবর্জনা সরানোর মতো নিয়মিত উদ্যোগ চোখে পড়ে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে তো বটেই শিল্পায়নের অভাব নিয়েও অভিযোগ ভুরি ভুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kalyani bitan bhattacharya soumitra sikdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE