Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ভালবাসার দিব্যি আর পঞ্চাদার গ্রেট ভি-ডে

টুং...টাং! আওয়াজটা এল বুকপকেট থেকে। আশপাশের লোকজন বুঝতে পারলেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল। কিন্তু পঞ্চাদা নির্বিকার। সাতসকালে মাছের বাজারে তিনি দরদাম করতে ব্যস্ত!

গৌরব বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৫১
Share: Save:

টুং...টাং!

আওয়াজটা এল বুকপকেট থেকে। আশপাশের লোকজন বুঝতে পারলেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল। কিন্তু পঞ্চাদা নির্বিকার।

সাতসকালে মাছের বাজারে তিনি দরদাম করতে ব্যস্ত!

—‘বলো কী হে! কই কই করতে করতে তোমার কাছে এলুম। আর তুমি কি না বলছ কই পাঁচশো টাকা কেজি!’

—‘আজ্ঞে, বোঝেন তো! বাজার একটু চড়া যাচ্ছে!

—‘চড়া মানেটা কী! এই দামে মাছ কিনতে হলে তো পকেটেও ধু ধু চর পড়ে যাবে হে!’

পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল জনা কয়েক ছোকরা—‘কালকেই ভি ডে তো। তাই হয়তো জলের মাছ ডাঙায় উঠতেই দাম বেড়ে গিয়েছে।’

খোঁচা খেয়ে পঞ্চাদার গলা এ বার সপ্তমে— ‘সক্কাল সক্কাল মসকরা হচ্ছে! রোজ সন্ধ্যায় তোদের বাপ কাকাদের সঙ্গে আড্ডা দিই রে। বলব নাকি তোদের কীর্তির কথা?’

যাদের উদ্দেশে এতগুলো শব্দ খরচ, তারা হেহে হাহা হিহি করতে করতে দূরে মিলিয়ে গিয়েছে।

আঁশটে আবহে পঞ্চাদা ফের মন দিলেন দরদামে। কিন্তু ছোঁড়ারা ভি-ডে না কি একটা যেন বলল। সেটা আবার কী!

বেশ কিছুটা ঘষটে, আরও কিছু বাক্য ব্যয় করে কই সাড়ে চারশোতে মিলল বটে। কিন্তু পঞ্চাদার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ভি-ডে...

পঞ্চাদা মানে আমাদের পঞ্চানন দাস। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। মাথায় তেলতেলে টাকের জন্য বয়স আরও দশ বছর বেশি দেখায়। চিরকাল হাড়কিপ্টে। আর দরদাম করতে শুরু করলে দোকানদারেরও ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়।

এমন বিটকেল স্বভাবের জন্য পঞ্চাদার স্ত্রী কখনও তাঁর সঙ্গে বাইরে বেরোতে চান না। কিন্তু পঞ্চাদার সেই এক বুলি—‘বুঝলে ভায়া তামাম দুনিয়া তোমার পকেট কাটার জন্য বসে রয়েছে। তোমাকে কিন্তু সামলে চলতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধও করতে হবে!’

যুদ্ধই বটে! রোজ সন্ধ্যার পরে বাজারের একপাশে মদনের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা বসে। সেখানে নিয়মিত হাজিরা দেন পঞ্চাদাও। এতদিন পকেটে থাকত মান্ধাতা আমলের একটি সাদা-কালো মোবাইল। ঠিক সাড়ে নটা নাগাদ পঞ্চাদার স্ত্রী সেই মোবাইলে ফোন করেন। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাদা ফোনটা কেটে দিয়ে বাড়ির নম্বরে একটা মিসড কল করেন।

কারণটা ওই, অকারণ পয়সা খরচের কোনও মানে হয় না। বাড়ি থেকে রাতে ওই ফোন আসা মানে বুঝতে হবে, রান্না রেডি। বাড়ি যেতে হবে। তারপর পঞ্চাদা যে মিসড কল করেন তার মানে হল— ‘এই এলুম বলে।’ আর বাড়িতে যদি জরুরি কোনও দরকার থাকে তাহলে প্রথম ফোনটি কেটে দেওয়ার পরে পঞ্চাদার স্ত্রী ফের ফোন করেন। মাথা খাটিয়ে এ ব্যবস্থা পঞ্চাদা তৈরি করেছেন।

সেই পঞ্চাদাকে দিয়ে স্মার্ট ফোন কেনানো যে যুদ্ধের সামিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। সৌজন্যে আমাদের লাগাতার টিপ্পনি এবং বেসরকারি একটি মোবাইল সংস্থার ঢালাও ফ্রি অফার। টাচস্ক্রিন স্মার্টফোন পকেটে ঢুকল বটে। কিন্তু পঞ্চাদা এখনও স্মার্ট হতে পারলেন না।

হোয়াটসঅ্যাপ, রিং টোন, সেটিং নিয়ে এখনও তিনি বেশ ঘেঁটে আছেন। এবং সেই কারণেই মাঝে মধ্যেই ঘ হয়ে বলেন, ‘তোদের পাল্লায় পড়ে মাইরি চাকরিটা কবে যাবে। আগের ফোনে সুইচ ছিল। লাল-সবুজ বোতাম টিপে দিব্যি কাজ চালানো যেত। আর এখন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ফোন কেটে যাচ্ছে।’ সকালে মাছের বাজারে যেমন। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। পঞ্চাদা কিন্তু বুঝতেই পারেননি।

বাজার সেরে বাড়িতে এসে গিন্নিকে এক কাপ চা করতে বলে মোবাইল নিয়ে বসলেন পঞ্চাদা। তখন তিনি দেখেন, হোয়াটসঅ্যাপে তিনটি মেসেজ। একটাও চেনা নম্বর নয়। একজন পাঠিয়েছে— ‘ভি ডে-কে অসংখ্য গোলাপ দিয়ে জয়যুক্ত করুন।’

পঞ্চাদার মনে পড়ে গেল, বাজারের সেই ছোকরাদের কথা। হ্যাঁ ওরা তো ভি ডে-ই বলছিল বটে। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, ভি ডে মানে কি কোনও ভোটের দিন-টিন? কিন্তু তাঁদের শান্তডাঙায় ভোট উদ্‌যাপন তো বোমা কিংবা ওয়ান শটার দিয়ে হয়। গোলাপের দরকার পড়বে কেন! নাহ্, আজকের সান্ধ্য আড্ডায় ভি ডে ব্যাপারটা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে।

পরের মেসেজটাই আবার আর এক গপ্প। বাড়িতে একজন পরিচারিকা কাজ করতে করতে বাড়ির মালকিনকে জিজ্ঞাসা করছে— ‘ও বৌদি তোমাদের পাঁজিটা দেখে একটু বলো না গো, ভেলেন্তিপুজো ক’টায় লাগবে আর কটায় ছাড়বে।’

—‘ভেলেন্তিপুজো আবার কী রে?’

—‘ওই যে গো, সবাই গোলাপ-টোলাপ কেনে। বৌদি, তোমার ওই লাল সিল্কের শাড়িটা আমার মেয়েটাকে এক বেলার জন্য দাও না গো! ভেলেন্তিপুজোয় পরবে।’

বাড়ির পরিচারিকার মুখে এমন কথা শুনে চা খেতে খেতে বিষম খেলেন বাড়ির কর্তা। পঞ্চাদা কিন্তু এ বার বেশ নার্ভাস বোধ করছেন। তিনি এত কম জানেন! বাঁইবাঁই করে ঘুরতে থাকা পৃথিবী জুড়ে কিছু একটা ঘটে চলেছে। অথচ তিনি, হ্যাঁ, একমাত্র তিনিই ব্যাপারটা কিছুতেই ধরতে পারছেন না।

সন্ধ্যায় মদনের চায়ের দোকান সরগরম। স্কুল মাস্টার প্রীতম, ব্লক অফিসের কর্মী হিমাদ্রী, ব্যবসায়ী তন্ময়, রিপোর্টার বসন্ত সকলেই হাজির। এবং যথারীতি চায়ের কাপে তুফান। পঞ্চাদা ঢুকতেই সবাই হইহই করে উঠল।

—‘আরে ওস্তাদ, এত দেরি করলে যে!’

—‘কী হল, মুখটা অমন পানসে কেন? বৌদির কাছে কি ফের ঝাড় খেয়েছ?’

কোনও ভণিতা, গৌরচন্দ্রিকা না করে পঞ্চাদা বললেন, ‘আচ্ছা, ভি ডে কেসটা কী রে?’ মুহূর্তে চায়ের দোকানে যেন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। তারপরে হো হো করে ফেটে পড়ল সবাই।

—‘আরে পঞ্চাদা, বলছ কী! স্মার্টফোন হাতে আসতে না আসতেই ভি-ডে নিয়ে খোঁজ নিচ্ছ যে ভারী! এই বয়সে কোথাও ছিপ-টিপ ফেলছ নাকি! বৌদি কিন্তু তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেবে।’

বড় গোবেচারা মুখ করে পঞ্চাদা বললেন, ‘আরে সে সব কিছু না। সকাল থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে কারা সব ভি ডে, ভেলেন্তিপুজোর মেসেজ পাঠাচ্ছে। ছাতার মাথা আমি কি এ সব বুঝি নাকি!’

এ বার খেই ধরল তন্ময়, ‘শোনো বস! কথাটা হচ্ছে ভ্যালেন্টাইন ডে। এখন লোকজন সেটাকেই সংক্ষেপে ভি ডে বলে। গোদা বাংলায় প্রেম দিবস! এই তো ক’দিন আগে গেল রোজ ডে, টেডি ডে। এমন মা-দিবস, বাবা-দিবসও আছে।’

মুহূর্তে পঞ্চাদার মনে পড়ল, একবার অফিসের কাজে সদর শহরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে একজন নিরাপত্তারক্ষী আই কার্ড দেখতে চেয়েছিল। ভ্যাবাচাকা খেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘না মানে, আমার তো চোখের কোনও সমস্যা নেই। আমি শুধু বড় সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করব।’

পরে তিনি জেনেছিলেন আইডেন্টিটি কার্ডকে সংক্ষেপে আই কার্ড বলে। কী কেলো! এ ভাবে সবাই যদি সংক্ষেপে কথা বলা শুরু করে তাহলে তো ভারী মুশকিল! জয়ন্তদা, তুমি কেমন আছ? না বলে হয়তো কেউ বলে বসবে জেডিটুকেআ!

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিড়বিড় করছেন পঞ্চাদা, ‘ভি ডে তাহলে প্রেমের দিন। আর ভ্যালেন্টাইন অপভ্রংশ হয়ে পরিচারিকার মুখে ভেলেন্তিপুজো! বোঝো কাণ্ড!’

—‘কী বিড়বিড় করছ বলো তো? এ বার থেকে এ সব তুমি মোবাইলে গুগল ঘেঁটেই বের করতে পারবে। তোমার সেটটা দাও। শিখিয়ে দিই। এই দ্যাখো, ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে গুগলও নানা মত দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, সময়টা তৃতীয় শতাব্দী। রোমে তখন সম্রাট ক্লডিয়াস টু-এর রাজত্ব। তিনি মনে করতেন, অবিবাহিত ছেলেরা উপযুক্ত সৈনিক হতে পারে। তাই নিষিদ্ধ করলেন তরুণদের বিয়ে। সম্রাটের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন এক সন্ন্যাসী। তিনি লুকিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন। ঘটনার কথা জানাজানি হলে সন্ন্যাসীকে ধরে মৃত্যুদণ্ড দেন সম্রাট। ওই সন্ন্যাসীর নাম সন্ত ভ্যালেন্টাইন। আবার এখানে বলছে...’

পঞ্চাদার দৃষ্টি গুমটি দোকানের জানলার বাইরে। তন্ময়ের গলা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। পড়ন্ত শীতের আবছা কুয়াশাতে এক এক করে ভেসে উঠছে পুরনো মুখ। তারা কেউ কলেজবেলার বন্ধু, কেউ তার কৈশোরের প্রিয় জন। ওই ছেলেটি কে? হ্যাঁ, শুভই তো। পঞ্চার কাছে অনেক আশা নিয়ে সে এসেছে সরস্বতী পুজোর দিন। তার কাতর অনুরোধ, ‘সরমাকে চিঠিটা একটু পৌঁছে দিবি? দেখিস, কেউ যেন জানতে না পারে!’

কী স্পর্ধা! শুভ কি জানে সরমার জন্য পঞ্চা কতটা পাগল? তার নিজের পকেটেও তো সরমাকে লেখা চিঠি। শুভ চলে যাওয়ার পরে রাগে অভিমানে তিন তলার ছাদ থেকে দু’টো চিঠিই কুচিকুচি করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল সে।

কুয়াশা ফুঁড়ে মদনের চায়ের দোকানের জানলার কাছে আস্তে আস্তে এ বার এগিয়ে আসছে সরমা। ফিসফিস করে বলছে, ‘ভীতুর ডিম কোথাকার! সাহস করে নিজের চিঠিটা তো দিতে পারতে!’ সরমার পিছনে ওই মেয়েটি কে? হ্যাঁ, তাঁদের গ্রামের সুলেখা! এখনও সেই একই রকম দেখতে। একটুও বয়স বাড়েনি। কিছু বলছে না। শুধু মিটিমিটি হাসছে। ঠিক আগের মতোই।

পঞ্চাদার গলাটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। হাতের সিগারেট হাতেই পুড়ে ছাই। চা জুড়িয়ে জল। পঞ্চাদার এমন চোখমুখ কেউ কোনও দিন দেখেনি। সকলেই উদ্বিগ্ন, ‘কী গো, শরীর খারাপ লাগছে?’

জানলার বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে পঞ্চাদা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘বুঝলে ভায়া, সহজ কথাটা বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল! ভালবাসার কোনও নির্দিষ্ট দিন-তিথি-নক্ষত্র থাকে না। তবুও বছরের একটা বিশেষ দিন ভালবাসার দিন হলে মন্দ কী!’

পঞ্চাদার মুখে এমন কথা শুনে সকলেই থ। নীরস, কাঠখোট্টা লোকটা কী বলছে এ সব! অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। বাড়ি থেকে পঞ্চাদার ফোন এল ঠিক সাড়ে ন’টায়। যেমন আসে। পঞ্চাদা কিন্তু ফোন কাটলেন না। গলাটা একটু ঝেড়ে নরম গলায় তিনি বললেন, ‘এই তো, এখনই উঠব। আর শোনো, কাল বিকেলে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে তোমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব। রাতের খাবারটা কোনও রেস্তোঁরাতেই খেয়ে নেব। আসলে কাল ভি-ডে তো!’

ফোন রাখার পরে আমরা সবাই জানতে চাইলাম, ‘বৌদি এ সব শুনে কী বললেন, পঞ্চাদা?’ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মুচকি হাসছেন পঞ্চাদা, ‘ওই আর কী, খুব আনন্দ হলে যা বলে— মরণ!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Valentines Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE