প্রতীকী ছবি।
মধ্য তিরিশের লক্ষ্মী দত্ত তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। এক দিন স্কুল যাওয়ার পথে নজরে পড়ে সদ্য খুন হওয়া রক্তাক্ত মৃতদেহ। মারত্মক ভয় পেয়েছিল বছর এগারোর মেয়েটি। বাড়ি ফিরে মাকে বলেওছিল। সেই ভয় আর কাটেনি।
তার পর থেকেই ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে মেয়েটি। আঠাশ বছর কেটে গিয়েছে। এখন ভারসাম্য বিশেষ নেই বললেই চলে। রেগে উঠলে বাড়িতে ভাঙচুর করেন। একে-তাকে মারেন। বাড়ির বাইরে গেলেই প্রতিবেশীদের নালিশ। বাধ্য হয়ে বাপ-মা মরা বোনকে অনেক সময়েই বাড়িতে আটকে রাখেন দাদা।
প্রাচীন মায়াপুর মণ্ডলপাড়ার বছর চৌত্রিশের অঞ্জলি কর্মকারের আবার বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। দেখে-শুনে মা-বাবাই বিয়ে দেন। এক বছরের মাথায় জামাই নিখোঁজ হয়ে যান। বাড়ি থেকে ফের চেষ্টা করলেও অঞ্জলি আর বিয়ে করতে চাননি। খুব ভাল সেলাইয়ের কাজ জানতেন। রেডিমেডের ব্যবসা করে বাড়িঘরও করেন। এরই মধ্যে রাস্তার কুকুর ধরে এনে স্নান করানো, খাওয়ানোর অভ্যেসও হয়ে যায় তাঁর।
এক দিন অঞ্জলির পোষা একটা কুকুর প্রতিবেশীর একটা বাচ্চাকে কামরায়। প্রতিবেশী চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। বাড়ির তিনটে কদম গাছ বিক্রি করে সেই টাকা দেন অঞ্জলি। তবুও কিছু লোক মিলে তাঁর পোষা তিনটি কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল চোখের সামনে। ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি অঞ্জলি। তার পর থেকেই কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। হারায় মানসিক ভারসাম্য।
নবদ্বীপ বাগানিয়াপাড়ার বছর চল্লিশের ইন্দ্রজিৎ সাহা ছোটবেলা থেকে মামার বাড়িতে মানুষ। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক হয়ে বর্ধমান থেকে এম কম করেন। তার পরে চাকরির পরীক্ষা জন্য তৈরি হওয়া। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। দিন-রাত বই মুখে বসে থেকে উল্টে চোখের সমস্যা দেখা দেয়। লেখাপড়াও বন্ধ হয়। সেই শুরু। প্রথমে একা-একা কথা বলা। এখন বছর আটেক ধরে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক রোগী। দিনরাত বাড়ির বাইরেই থাকতেন। নিজের মনে কথা বিড়বিড় করতে-করতে গোটা শহর ঘুরে বেড়াতেন ইন্দ্রজিৎ।
এই সব অসুস্থকে নিয়ে বড় কষ্টে থাকেন বাড়ির লোকেরা। কারও ঘরে মানসিক ভারসাম্যহীন ভাগ্নে, তো কারও বোন, কারও মেয়ে। ওঁদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। টাকার অভাবে চিকিৎসাও হয়নি। অথচ পাড়াপড়শি তাঁদের রেয়াত করতে নারাজ। পরিজনেরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন আদালতের। আদালতের নির্দেশেই শুক্রবার ওই তিন জনকে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে পৌঁছে দিল নবদ্বীপ থানার পুলিশ।
রামসীতাপাড়ার লক্ষ্মী দত্তের দাদা সুনীল দত্ত বলেন, “সামান্য সাইকেল মেরামতির কাজ করে বোনের চিকিৎসা করাতে পারিনি। খুবই কষ্টে সংসার চলে। এ বার মনে হচ্ছে বোন ভাল হয়ে যাবে।” বাগানিয়াপাড়ার ইন্দ্রজিৎ সাহার মামা ভরত সাহার কথায়, “চাকরি না-পাওয়ার হতাশা, তার উপরে চোখের চিকিৎসা করাতে না পেরে ওর এই অবস্থা।” রেডিমেড কাটিংয়ের কাজ করে ভরত এক বার ভাগ্নেকে বর্ধমানে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা করাতে পারেননি। মণ্ডলপাড়ার অনিমা কর্মকার বলেন, “আমরা হতদরিদ্র, যা কিছু সহায় সম্বল ছিল মেয়ের চিকিৎসা শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে ও-ই তো রোজগার করত।”
আপাতত পরিবারগুলি আশার আলো দেখছে। দেখতেই পারে। সম্প্রতি প্রাচীন মায়াপুরের রাখাল মণ্ডল বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy