Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ছাদনাতলা থেকে সাইকেলটা তাকে নিয়ে চলল স্কুল পথ ধরে

থানার লম্বা বেঞ্চের কোণায় গোঁ ধরে বসে থাকা মহিলা শেষতক ছুড়ে দিলেন প্রশ্নটা— ‘‘দু’মাইল পথ ভেঙে মেয়ে আমার ইস্কুলে যাবি কী কইরা শুনি, এগডা ছাইকিলও (সাইকেল) কি আসে (আছে)?’’

সাইকেল হাতে রুনা। —নিজস্ব চিত্র

সাইকেল হাতে রুনা। —নিজস্ব চিত্র

সুজাউদ্দিন
রানিনগর  শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১৯
Share: Save:

থানার লম্বা বেঞ্চের কোণায় গোঁ ধরে বসে থাকা মহিলা শেষতক ছুড়ে দিলেন প্রশ্নটা— ‘‘দু’মাইল পথ ভেঙে মেয়ে আমার ইস্কুলে যাবি কী কইরা শুনি, এগডা ছাইকিলও (সাইকেল) কি আসে (আছে)?’’

রং-হারা আঁচলের ময়লা শাড়ি। ধান ভাঙার কাজ ফেলে থানায় এসেছেন একাই। যাকে নিয়ে এত ‘কাণ্ড’, সেই ক্লাশ সিক্সের বড় মেয়ে রুনা অবশ্য সঙ্গে আসেনি। তার স্কুলের ‘পড়া’ আছে। যে পড়া থমকে যাচ্ছে ওই একখানা সাইকেলের ‘দূরত্বে’।

আর সেই সুযোগে, সাকুল্যে বছর চোদ্দোর রুনা খাতুনের বিয়েটা পাকা করে ফেলেছিলেন মা লালভানু।

রানিনগর থানার বড়বাবু, অরূপ রায় অবশ্য সুযোগের-সেতুটুকু বাঁধতে দেননি। কালীপুজোর রাতে একটা ঝকঝকে সাইকেল কিনে নিজেই তুলে দিয়েছেন রুনার হাতে।

মেয়ের আবার পড়া? মনে মনে মুখ ঝামটা দেন লালভানু বেওয়া। বাপ-মরা তিন-তিনটে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চার বছর ধরে কী করে চলছে তাঁর তা কি ওরা বুঝবে?

আর বুঝবে না বলেই মেয়ের বিয়েটা ভেস্তে দিতে তাঁর তলব পড়েছে থানায়! মনে মনে গুমরে যাচ্ছিলেন লালভানু।

ও পাড়ার আয়েশা, পড়শি গ্রামের রুবেইনা— তাদের কি বিয়ে হয়নি কম বয়সে? তবে, বিয়ের পরের বছরই প্রসবের সময়ে মারা গিয়েছিল রুবেইনা, আর করিনার চেহারাটা? নাঃ, ভিতরে ভিতরে শিউড়ে ওঠেন লালভানু। কিন্তু ভাঙলে চলবে না, তাই উর্দি পরা মানুষটার সঙ্গে সমানে ঠেস দিয়ে তর্ক করে চলেছিলেন।

রুনা সবে চোদ্দো, এখনই বিয়ে?

রানিনগর থানায় চাপা গলায় সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিল একটা উড়ো ফোন। যে থানার বড়বাবুকে মনে আছে? অরূপ রায়, নাবালিকা বিয়ে রুখতে আশপাশের স্কুলে এমনকী গ্রামে ঘুরেও সমানে প্রচার করে বেশ পরিচিত তিনি।

বড়বাবুর ঘরের সবুজ পর্দা সরিয়ে সবে উঁকি মেরেছিলেন ডিউটি অফিসার, ‘স্যার আবার একটা ফোন...’—কথাটা শেষ হয়নি। অরূপ যেন আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন। মোটরসাইকেল গর্জে সে দুপুরেই ছুটেছিলেন খামারপাড়া গ্রামে।

প্রথম দফায় বাড়ি, তার পরে লালভানুর তলব হয়েছিল থানায়। তবে মহিলা থানায় এসে সটান বলে বসেছিলেন, ‘‘এত যে পড়ার কথা বলছেন স্যার, বাড়ি থেকে স্কুল— অতটা পথ মেয়ে বাঙবে কি করে শুনি?’’ রানিনগর থানায় বসে লালভানু বেওয়ার কথাটা, অরূপের কানে বিঁধেছিল। বলছেন, ‘‘একটা সাইকেলের জন্য মেয়েটার পড়া আটকে যাবে! তাই একটা উপায় বের করার চেষ্টাশুরু করি। ভেবে নিয়েছিলাম যে করেই হোক সাইকেল একটা যোগাড় করতেই হবে।’’

কালীপুজোর সাঁঝে সেই সাইকেলটাই দীপাবলীর আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিল রুনার হাতে।

রুনা বলছে, ‘‘বছর চারেক আগে বাবা মারা যাওয়ায় আমি যেন মায়ের কাছে বোঝা হয়ে উঠছিলাম!’’ কেন? তরতরে মেয়েটি উত্তর দিচ্ছে— ‘‘বিয়ে নয়, পড়তে চাইছিলাম যে!’’

লালভানু বলছেন, ‘‘টানাটানির সংসারে কি আর ও সব (পড়াশোনা) টানা যায়, পাশের গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে তাই বিয়েটা পাকা করে ফেলেছিলাম। এমনকী দেনমোহর পর্বও সারা হয়ে গিয়েছিল। তবে কি জানেন, বড়বাবুর কথা ফেলতে পারলাম না!’’

দীপাবলীর সাঁঝে ঝলমলে সাইকেলটা নিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে দেখছিল রুনা। চালাতে পারিস? যতটা সম্ভব ঘাড় হেলিয়ে রুনা বলছে, ‘‘হ্যাঁ’’। যেন, এই আঁধার সাঁঝে ছাতনাতলা থেকে সেই সাইকেল তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল
স্কুলের পথে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

education marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE