কানা ময়ূরাক্ষী থেকে তুলে আনা হচ্ছে ছাত্রের দেহ। —নিজস্ব চিত্র
বর্ষা এলেই একলাফে আশঙ্কাটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
মঙ্গলবার বিকেলে সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কানাময়ূরাক্ষীতে নৌকা ডুবে মৃত্যু হল এক পড়ুয়ার। জ্যোতির্ময় সরকার (১৫) নামে দশম শ্রেণির ওই পড়ুয়ার বাড়ি খড়গ্রামের হরিনারায়ণপুরে। সে কান্দির পুরন্দরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ত।
এ দিন ধামালিপাড়া গ্রাম লাগোয়া কানাময়ূরাক্ষীর এমন ঘটনার পরে জ্যোতির্ময়ের বাবা নরেন্দ্রনাথবাবু বলছেন, ‘‘রোজ নদী পেরিয়ে ছেলেটি স্কুলে যেত। যতক্ষণ বাড়ি না ফিরত ততক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সবসময় মনে হত, বর্ষার নদীতে কিছু অঘটন ঘটল না তো! আজ সেটাই ঘটে গেল।’’
নরেন্দ্রনাথবাবু একা নন, বর্ষার মরসুমে এমন আশঙ্কায় দিন কাটান খড়গ্রাম ধামালিপাড়া, হরিনারায়ণপুর, মনসবপুর, রায়পুর, কেশবপুরের মতো প্রায় দশটি গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, বছরভর ধু ধু করে কানাময়ূরাক্ষী। মাটি খুঁড়েও জল মেলে না। বর্ষা এলেই টইটম্বুর হয়ে যায় এই ‘কানা’ নদী।
নদীর পূর্ব পাড়ে কান্দি, পশ্চিমে খড়গ্রাম। খড়গ্রামের ওই নদী পাড়ের বহু পড়ুয়া পড়ে কান্দির বিভিন্ন স্কুলে। বছরের অন্য সময় তেমন চিন্তা না থাকলেও বর্ষায় এই সময়টা তাঁদের নদী পার হতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, নদী পার হতে হয়। অথচ কোনও ফেরিঘাট নেই। নৌকায় মাঝি থাকেন বটে। তবে কোনও অঘটন ঘটলে কারও কিছু করার থাকে না। কারণ, প্রায় দেড়শো মিটার চওড়া ওই নদীতে দড়ি টেনে টেনে নৌকা বাইতে হয়।
এ দিনও সে ভাবেই পুরন্দরপুর ঘাট থেকে নৌকাটি এগোচ্ছিল ধামালিপাড়ার দিকে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানতে পেরেছে, নৌকাতে প্রায় ৩৫ জন পড়ুয়া ছিল। তাদের সঙ্গে চারটে সাইকেলও ছিল। কিন্তু সেই সময় নৌকার মাঝি বাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন। মাঝির জন্য অপেক্ষা না করেই ওই পড়ুয়ারা নৌকায় চেপে দড়ি টেনে টেনে পাড়ের দিকে আসছিল।
আচমকা দড়ির চাপে নৌকার একটি বাঁশ ভেঙে যায়। আর তাতেই দড়িটি নৌকার মাঝে চলে আসে। তখন পড়ুয়ারা সকলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে নৌকার এক দিকে। তখনই টাল সামলাতে না পেরে নৌকাটি উল্টে যায়।
নৌকায় থাকা পড়ুয়া শিখা খাতুন, সৌকত আলিদের কথায়, “মাঝেমধ্যেই মাঝি না থাকলে আমরা তো এ ভাবেই নদী পার হই। কিন্তু এ দিন ওই বাঁশটি ভেঙে যাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটে গেল।’’ সকলেই পড়ে গিয়েছিল মাঝ নদীতে। তাঁদের অনকেই সাঁতরে পাড়ে উঠে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারাও সঙ্গে সঙ্গে নদীতে নেমে পড়েন। তাঁরাও বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করে। কিন্তু জ্যোতির্ময় সাঁতার জানত না। তাছাড়া সাইকেলের মধ্যে সে আটকে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পরে তাঁর নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়।’’
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই এই নদীর উপরে সেতুর আবেদন করা হলেও প্রশাসন সে কথায় কান দেয়নি। খড়্গামের এই এলাকা থেকে নদী পার হয়ে খুব সহজেই কান্দির নানা এলাকায় যাওয়া যায়। অন্য ভাবে যেতে গেলে প্রায় ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। এ দিন ঘটনার পরে খড়গ্রামের বিডিও খুরশিদ আলম গেলে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা।
সেতু নির্মাণের জন্য প্রশাসন উদ্যোগী হবে বলে লিখিত আশ্বাস দেওয়ার পরেই শান্ত হন ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। খুরশিদ আলম বলেন, “এমন ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। অবিলম্বে এই নদীর উপরে যাতে সেতু হয় সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনকে জানাব।’’
মোধাবী ও মিশুকে ছেলে বলে পরিচিত ছিল জ্যোতির্ময়। এ দিনের ঘটনার পরে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে হরিনারায়ণপুর। তাঁর বাবা নরেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘সরকারের কাছে আমার একটাই আর্জি, আমাদের মতো আর কোনও বাবা-মায়ের যেন এ ভাবে কোল খালি না হয়। সেতু থাকলে আমার ছেলেটাকেও এ ভাবে হারাতে হত না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy