Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমবায় গড়েই বড় হয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা

ওঁরা কেউ চায়ের দোকানি, কেউ মুদিখানার মালিক, কেউ শালপাতার ঠোঙা তৈরি করে বিক্রি করেন, কেউ আবার সব্জি বিক্রেতা। ওঁরা বুঝেছেন, একজোট হয়ে না দাঁড়ালে বিপদে-আপদে সামাল দিতে পারবেন না। ওঁদের সেই জোটের নাম ‘জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি’। ওঁদের বড় সম্বল।

সমিতির সম্মেলন। —ফাইল চিত্র।

সমিতির সম্মেলন। —ফাইল চিত্র।

অনল আবেদিন
জিয়াগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০১:২৯
Share: Save:

ওঁরা কেউ চায়ের দোকানি, কেউ মুদিখানার মালিক, কেউ শালপাতার ঠোঙা তৈরি করে বিক্রি করেন, কেউ আবার সব্জি বিক্রেতা।

ওঁরা বুঝেছেন, একজোট হয়ে না দাঁড়ালে বিপদে-আপদে সামাল দিতে পারবেন না। ওঁদের সেই জোটের নাম ‘জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি’। ওঁদের বড় সম্বল।

কী রকম?

বয়স ষাট পেরোলেই স্বল্প পুঁজির ক্ষুদ্র ব্যবয়াসীদের জন্য অবসরকালীন মাসিক ১০০০ টাকা ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। ঈদে-পুজোয় মেলে বোনাস। সত্‌কার-শ্রাদ্ধের জন্য ভাতা হিসাবে ৫০ হাজার টাকা। মাসিক মাত্র ৪০ টাকা টিউশন ফি-র বিনিময়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাড়নো চলছে দেড় দশক ধরে। ব্যবসা বাড়তে অথবা পারিবারিক জরুরি প্রয়োজনে পুঁজি পেতে ব্যাঙ্কে দৌড়ঝাঁপ করে তাঁদের জুতোর সুকতলা খোয়াতে হয় না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সুদের হারেই তাঁদের হাতে পৌঁছে যায় সহজ শর্তের ঋণ।

বেসরকারি অথর্লগ্নি সংস্থার বুদবুদ ফেটে যখন রাজ্যের অজস্র লগ্নিকারী ধরাশায়ী, মুর্শিদাবাদের এই সমিতির মডেল এখন অন্য পথ দেখাচ্ছে। সমিতির কাজকর্মের পরিধি এক দিকে ভগবানগোলা হয়ে বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া পদ্মাপাড়ের রানিতলা থানা এলাকা পর্যন্ত। অন্য দিকে বহরমপুর শহরের উপকণ্ঠে লালবাগ পর্যন্ত। জন্মলগ্ন থেকে প্রায় তিন দশকে চারটি থানা এলাকা জুড়ে তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।

জিয়াগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মী তথা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সমীর ঘোষ বলেন, “কেবল সমিতির সদস্যদের বা তাদের পরিবারের কল্যাণ চিন্তা নিয়েই আটকে থাকেনি সংগঠনটি। প্রতি বছর ৫ জন মেধাবী অথচ দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীর ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যয়ভারও তারা তুলে কাঁধে নিয়েছে।” এলাকার ১০টি স্কুলের ৩০ জন দুঃস্থ কিন্তু মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষার অন্য ক্ষেত্রেও উত্‌সাহ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এ বছর সমিতির ৩০তম বাত্‌সরিক সম্মেলনে। ফেব্রুয়ারিতে জিয়াগঞ্জে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের আদলে বিশাল মঞ্চ করে দু’দিন ধরে ওই সম্মেলন হয়েছে।

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়ক যন্ত্র বিলি আগেই প্রতি বছরের কর্মসূচি হয়ে উঠেছে। গত বছর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনা পয়সায় ছানি কাটিয়ে, চশমা বিলিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে এলাকার সব বয়স্ক মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রকল্প। কী ভাবে এত বড় কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা? সম্মেলনে প্রকাশিত ‘ব্যবসায়ী বান্ধব’ পুস্তিকায় তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পুস্তিকার সম্পাদক মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “তুচ্ছাতিতুচ্ছ লোক বলে সমাজে পাত্তা পাওয়াটি ছিল দুষ্কর, অপেক্ষাকৃত ধনশালী বলশালীরা অধিকাংশ সময়ে হেয় জ্ঞান করত, পুঁজির জন্য ব্যাঙ্ক কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালে পরিণতি হত অবজ্ঞা আর অনাদর। এই আত্মধিক্কার আত্মযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সংগঠনের জন্ম।”

সেই সময়ে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে মুত্‌সুদ্দির রমরমা কারবার ছিল। ১০০ টাকা ধার নিলে দৈনিক ১০ টাকা পরিশোধের শর্তে মহাজনকে মাসের শেষে সুদে-আসলে মোট ৩০০ টাকা ফেরত দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সমিতির এক কর্মকর্তা নিতাই দাস বলেন, “সদস্য পিছু দৈনিক ২৫ পয়সা জামানো দিয়ে ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই সমিতির পথ চলা শুরু। পরে তা ধাপে ধাপে বেড়ে সদস্যদের দৈনিক এক টাকা দিতে হয় সমিতির তহবিলে।” অর্থাত্‌ বর্তমানে সমিতির তহবিলে দৈনিক জমা পড়ে ১৫ হাজার টাকা। ৬০ বছর বয়স হলে মাসিক ১০০০ টাকা অবসরকালীন ভাতা দেওয়া হয়।

তবে মাসিক জমা পড়া এক টাকায় যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরুণ সাহা জানান, সমিতির নিজের এক ধরনের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে প্রতিটি সদস্য পাসবই খুলে সাধ্য মতো টাকা রাখেন। তার মধ্যে শতকরা ১০ টাকা জমা থাকে মৃত্যুকালীন ভাতা দেওয়ার জন্য। পাঁচ বছর পরে জমানো টাকার ৭৫ শতাংশ ওই সদস্য ব্যাঙ্কের সুদের হারে ঋণ নিতে পারেন। সদস্যদের জমানো টাকা থেকে শতকরা ১৪ টাকা সুদের হিসাবে পুজো ও ঈদের সময় সদস্যদের বোনাস দেওয়া হয়।

অরুণবাবু বলেন, “সমিতির পক্ষ থেকে সারা বছর বিচিত্রানুষ্ঠান, যাত্রা ও খেলাধুলোর মাধ্যমেও কিছু অর্থ সংগ্রহ হয়।” ওই টাকা থেকে বেশ কিছু দুঃস্থ মহিলাকে দেওয়া হয়েছে গাভী, সেলাই মেশিন, নিটিং ও কাটিং মেশিন, শালপাতার থালা-বাটি তৈরির উপকরণ। এমন শতাধিক মহিলার মধ্যে রয়েছেন জিয়াগঞ্জের মালতী মণ্ডল, পার্বতী দাস, মিনতি দেবীরা। কেউ শালপাতার থালা-বাটি তৈরি করেন, কেউ নিটিং ও কাটিং মেশিনে পোশাক বানান বা গোপালন করে দুধের ব্যবসা করেন। তাঁদের এক কথা, “ক্ষূদ্র ব্যবসায়ী সমিতি না থাকলে আমরা না খেতে পেয়ে মারা পড়তাম।”

সদস্য পরিবারের সন্তানদের জন্য ‘মর্নিং গ্লোরি’ নামে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলও চালাচ্ছে সমিতি। নার্সারি থেকে থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। স্কুলের বয়স এখন ১৬ বছর। গত বাত্‌সরিক সম্মেলনে স্কুলটিকে দ্বাদশ শ্রেণিতে উন্নীত করার সিদ্ধান্তও পাকা হয়ে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE