প্রধান শিক্ষক সমিতির রাজ্য সম্মেলন। কৃষ্ণনগরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
স্কুল এক। কিন্তু শিক্ষকেরা যেন খেলছেন বিপরীত টিমে। শনিবার দুপুরে কৃষ্ণনগরে প্রধান শিক্ষক সমিতির রাজ্য সম্মেলনে এসে প্রধান শিক্ষক ও সহ-শিক্ষকদের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের প্রসঙ্গ টানলেন রাজ্যের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জৈব প্রযুক্তি দফতরের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পরামর্শ, দ্রুত নিজেদের মধ্যে শত্রুতা দূর করুন শিক্ষকেরা।
এ দিনের সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। প্রধান শিক্ষক যদি হ’ন মোহনবাগান, তা হলে সহ-শিক্ষকেরা যেন ইস্টবেঙ্গল। তাঁর প্রশ্ন, প্রধান শিক্ষক কি সহ-শিক্ষকদের জাতশত্রু? এ ভাবে তাঁদের হেয় করা কি শিক্ষকদের ধর্ম-আদর্শ? মন্ত্রীর পরামর্শ, ‘‘শিক্ষার পরিবেশ ভাল রাখতে নিজেদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক রাখুন। একসঙ্গে কাজ করুন।’’
রবিরঞ্জনের বক্তব্য যে অমূলক নয় তা মানছেন বহু প্রধান শিক্ষকই। এ দিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন, নদিয়া ও বীরভূমের এমন দু’জন প্রধান শিক্ষক বলছেন, ‘‘মন্ত্রীমশাই একেবারেই ঠিক কথা বলছেন। তবে আমাদের দায়িত্বটা আবার অনেক ক্ষেত্রে রেফারির হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষকতা যে মহান পেশা, তা ভুলে গিয়েছেন এই প্রজন্মের অনেকেই।’’ তাঁদের অভিযোগ, স্কুলে এসে সহ-শিক্ষকদের প্রথম চেষ্টাই থাকে, কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায়। দেরি করে এলেও যেন তাঁদের খাতায় লাল কালির দাগ না পড়ে। দু’টো ক্ষেত্রেই অন্যতম কারণ প্রাইভেট টিউশন। সেখানে বাধা দিলেই শুরু হয় সংঘাত। একজনের দায়িত্ব যে কখনও কখনও আর একজনকে ভাগ করে নিতে হয় এটা বোঝানোর জন্য যে শিক্ষকদের উপরেও শিক্ষকতা করতে হবে, এটা ভাবিনি।’’
বীরভূমের আর এক সহ-শিক্ষকের অভিজ্ঞতা আবার অন্য রকম। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বেশ কিছু প্রধান শিক্ষক অযোগ্য ও নরম ধাতের। সে জন্য তাঁরা নিজেদের প্রশাসনিক কাজ সহ-শিক্ষকদের দিয়ে করিয়ে নেন। সেই কারণে ওই সহ-শিক্ষকেরা বাড়তি সুবিধাও নেন। ফলে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকদের যে বিরোধ বাধবে, এটাই স্বাভাবিক।’’
নদিয়ার মুড়াগাছা মাল্টি পারপাস হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিমলেন্দু সিংহ রায় বলেন, ‘‘সর্বত্র এই ধরনের ঘটনা ঘটে না। তবে স্কুল চালাতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে মতবিরোধ ঘটে। সেক্ষেত্রে উভয়কেই মানিয়ে চলতে হবে।’’
হলদিয়ার মনোহরপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রাণনাথ শেঠ আবার বলছেন, ‘‘যে সব শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়, তাঁদের সঙ্গেই এই ধরনের মতবিরোধ হয় প্রধান শিক্ষকদের। এটা শিক্ষার পরিবেশে ক্ষতিকর দিক।’’
হলদিয়ার দেউলপোতা হাইস্কুলের সহ-শিক্ষক অসিত শতপথী জানান, কিছু ক্ষেত্রে প্রধানশিক্ষক সহ-শিক্ষকদের উপরে ছড়ি ঘোরান। আবার কিছু সহ-শিক্ষক তাঁদের মূল্যবোধ হারিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শিক্ষকদের জন্য ছাত্র নয়। ছাত্রদের জন্য শিক্ষক।’’
তবে স্কুলশিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি রবিরঞ্জনবাবু। এ দিন সম্মেলনে তিনি বলেন, আগে একজন মাধ্যমিক পাশ ছাত্রের শিক্ষার মান যতটা ছিল এখন স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ ছাত্রের সেই মানটুকু নেই। নব্বই শতাংশ নম্বর পেলেও মান খারাপ হওয়ায় চাকরির পরীক্ষার প্যানেলে জায়গা পাচ্ছে না, এমন নজিরও রয়েছে, মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
এ দিন রীতিমতো সমালোচনার সুরে মন্ত্রী শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘শুধু বেতন বৃদ্ধি, বদলি নিয়ে ভাবলে হবে না। শিক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে।’’ অন্যের দোষ না দেখে আত্মসমালোচনার উপর জোর দেন তিনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি শিক্ষকদের আকর্ষণ কম বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন ‘‘আগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রভাব ছিল। এখন শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতে এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলায় শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকর্ষণ থাকছেনা। হয়তো কোনও একদিন সরকারকে শিক্ষক নিয়োগের আগের পদ্ধতির কথা ভাবতে হতে পারে।’’
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রবিরঞ্জনবাবু বলেন যে ছাত্রদের মান ভাল, তাদের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না। যাদের মান কম তাদের ওপরে তুলতে হবে শিক্ষকদের। মূল্যবোধ তৈরি করাই যে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য, তা তিনি জানান। শনিবার কৃষ্ণনগরের কালিনগরে একটি বেসরকারি লজে পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির রাজ্য সম্মেলন শুরু হয়েছে। চলবে আজ, রবিবার পর্যন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy