রাস্তা ফাঁকা করতে লাঠিচার্জ। কৃষ্ণনগরে।ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
কেউ রাস্তায় নেমেছিলেন হাওয়া খেতে, কেউ বা জরুরি প্রয়োজনে। বাদ সাধল পুলিশ!
বেলা সাড়ে ১০টা। স্কুটিতে বন্ধুকে চড়িয়ে নবদ্বীপ বড়ালঘাটে হাজির পিন্টু দেবনাথ। তাঁর বাড়ি শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাবলারি পঞ্চায়েতে। ছুটির সকালে শখ হয়েছে রামকৃষ্ণ ঘোষের দোকানের লাল দই খাওয়ার। কিন্তু হা কপাল! দোকান যে বন্ধ।
সোমবার রাতেই সেজেগুজে স্বামীর বাইকে চড়ে লকডাউন প্রত্যক্ষ করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন অনেকে। বিভিন্ন শহরের মোড়ে জমিয়ে আড্ডা দিতে দেখা গিয়েছে অনেককে। মিষ্টির দোকান থেকে রুটির দোকান, ফুচকা থেকে পার্লার কম বেশি সকলেই খুলে বসেছিলেন। সেই প্রবণতাটা যে পাল্টায়নি, তা পরিষ্কার হয়ে গেল মঙ্গলবার। চাকদহের কালীবাজার হোক বা কৃষ্ণনগরের পোস্ট অফিস মোড় বা শান্তিপুরের ডাকঘর মোড়। প্রথম দিকে চায়ের দোকানের ভিড় দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না যে লকডাউন চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সব ছবি পোস্ট হতে থাকে। থানায় ঘনঘন ফোন যায়। তার পরেই পুলিশ নড়ে বসে।
বেলা প্রায় ১২টা। সাইকেল চালিয়ে কৃষ্ণনগরের পোস্ট অফিস মোড় থেকে পুরসভা মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন এক জন। রাস্তা আটকালেন কোতোয়ালি থানার এক অফিসার। সঙ্গে গোটা তিন সিভিক ভলান্টিয়ার। অফিসার জানতে চাইলেন, “কোথায় গিয়েছিলেন?” সাইকেল আরোহী মিনমিন করে বললেন, “বাজারে, শসা কিনতে।” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কোমরে পড়ল লাঠির বাড়ি, আর সেই সঙ্গে ধমক— “শসার জন্য বাজারে যাওয়া হয়েছে? যেন শসা না খেলে আজই মরে যাবে!”
এরই মধ্যে কিন্তু পুলিশ বেশ কয়েক জন সাইকেল ও মোটরবাইক আরোহীকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ তাঁরা কেউ বেরিয়েছেন ওষুধ কিনতে, কারও থলিতে আবার চাল। সদর মোড় থেকে পোস্ট অফিস মোড়ের দিকে এগিয়ে আসছিল যাত্রী বোঝাই টোটো। যাচ্ছিল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। তাতে তিন জন সওয়ারি। পুলিশ সেটি থামায়। তার পর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে চাকার হাওয়া খুলে দেয়।
সকালে পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খোলা দোরান বন্ধ করান চাকদহের বিডিও। অনেকে আবার দোকান খোলার সপক্ষে নানা যুক্তি খাড়া করেন। রানাঘাট, শিমুরালি, মদনপুরেও বিভিন্ন বাজারে গিয়ে পুলিশ দোকান বন্ধ করায়। আলাইপুরে একটি তাসের আসরেও হানা দেওয়া হয়।
লকডাউন অগ্রাহ্য করে অহেতুক জটলা করায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। পথচলতি মোটরবাইক বা গাড়ি থামিয়ে পুলিশ জানতে চায় যে কী কারণে তিনি বাইরে বেরিয়েছেন। এটা-সেটা বানিয়ে বলে রেহাই মেলেনি। ওষুধ কিনতে বেরনোর কথা বললে দেখাতে হয়েছে রসিদ। বাজারের থলি পরীক্ষা করে পুলিশ দেখেছে আদৌ তিনি বাজারে গিয়েছিলেন কি না।
পরে পুলিশ কিছু লোককে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করে। পরে অবশ্য তাঁদের ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দেওয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোতোয়ালি থানা এমন ১৫ জনকে ও শান্তিপুর থানা গ্রেফতার সাত জনকে গ্রেফতার করেছে। একই ভাবে অন্য কিছু থানাও ধরপাকড় চালিয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন রাজ্য থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে গ্রেফতার বা লাঠি চালানো নয়, মূলত সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে সচেতন করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে। সেই মতো জেলার পুলিশ কর্তারা বিভিন্ন থানায় নির্দেশও দিতে শুরু করেছেন। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার জাফর আজমল কিদোয়াই বলছেন, “বিষয়টা মানবিক দিক দিয়ে দেখতে হবে। যাঁরা বাইরে এসে জটলা করছেন বা ভিড় করছেন তাঁদের আমরা বুঝিয়ে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করছি। মানুষকে সচেতন করেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।”
কিন্তু বাস্তবে সেটা করা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তাও তাঁরা বলছেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এক জায়গা থেকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার পর সেই লোক অন্য জায়গায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এ দিন সদর মোড়ে দাঁড়িয়ে এ রকমই এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “গোটা একটা দিন ধরে ঘরে বসে থাকা কি সম্ভব? ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। তাই একটু বেরোলাম।”
এখন ২১ দিন তাঁরা কী ভাবে ঘরে কাটাবেন, সেটাই বড় ভাবনার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy