Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

হাত ধোবেন, ভদকা কিনে বাড়ি গেলেন মা-মেয়ে

মদ যে আগের তুলনায় বেশি বিক্রি হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে দোকানিদের কথাতেও। কৃষ্ণনগরের এক মদের দোকান থেকে গত পাঁচ দিনে হাজার বোতল বাংলা মদ বেশি বিক্রি হয়েছে।

মদ কিনতে লাইন। শনিবার কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র

মদ কিনতে লাইন। শনিবার কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র

সুদীপ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৬:১৩
Share: Save:

বাংলা মদে অ্যালকোহলের পার্সেন্টেজ কত বলতে পারেন?

মদের কাউন্টারের ভিতর থেকে কোনও উত্তর এল না। একটু অপেক্ষা করে প্রশ্নকর্তা একটু হতাশ গলাতেই বললেন, ‘‘একটা ছোট বোতল দিয়ে দিন তা হলে, দেখি কাজ হয় কি না।’’ কী কাজ? কৃষ্ণনগর আনন্দময়ীতলায় মদের কাউন্টারে আসা যুবকটি খোলসা করলেন, ‘‘বাজারে স্যানিটাইজ়ার পাচ্ছি না। যা পাওয়া যাচ্ছে তার অনেক দাম। তাই সস্তায় বাংলা মদ কিনছি হাত ধোয়ার জন্য।’’

ওই যুবক একা নন। করোনা আতঙ্কে স্যানিটাইজ়ার না পেয়ে হাত ধোয়ার জন্য অনেকেই মদের খোঁজ করছেন। শনিবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগরের এক মদের দোকানি বলেন, ‘‘এই তো ক’দিন আগেই এক মহিলা তাঁর মায়ের সঙ্গে দোকানে এসে হাত ধোয়ার জন্য কোন মদ ভাল তা জানতে চাইছিলেন। শেষে এক বোতল ভদকা কিনে নিয়ে গেলেন হাত ধোবেন বলে।’’

কেউ কেউ তো আবার এক ধাপ এগিয়ে মদ খাওয়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন এই যুক্তিতে যে, মদ খেলে শরীর গরম থাকছে এবং গরম জায়গায় করোনার ভাইরাস মরে যায়! তেহট্টের এক মদের দোকানি জানালেন, রোজ বিকেলে এক ভদ্রলোক এসে রাম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন শরীর গরম রাখার জন্য। ইদানীং তাঁর দোকানে রামের বিক্রি বেড়েছে বলেও জানালেন তিনি।

কে না জানে, ‘পিনেওয়ালোকো পিনে কা বাহানা চাহিয়ে’! সেই রসের রসিক যাঁরা, তাঁরা মদ্যপান বাড়ানোর এ হেন অজুহাত খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা! তাঁদের এক কথা, মদ খেলে করোনা প্রতিরোধ করা যায়। তাই মদের দোকানে সকাল-বিকেল লাইন লাগাচ্ছেন। এই নিয়ে প্রশ্ন তুললেই কেউ-কেউ স্রেফ দার্শনিক— ‘‘এ বার তো মরার সময় হয়েই এসেছে। ক’টা দিন খেয়েই মরি।’’ কেউ কেউ আবার সত্যিই বিশ্বাস করছেন যে মদ খেলে করোনা কাছে ঘেঁষবে না। তাঁদের মতে, অ্যালকোহল দিয়ে হাত ধুতে বলা হচ্ছে যখন, খেলেও নিশ্চয়ই দেহের ভিতর কিছুটা ধোয়া হয়ে যাবে।

মদ যে আগের তুলনায় বেশি বিক্রি হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে দোকানিদের কথাতেও। কৃষ্ণনগরের এক মদের দোকান থেকে গত পাঁচ দিনে হাজার বোতল বাংলা মদ বেশি বিক্রি হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ, পিকনিক বা এই জাতীয় যে সব জমায়েতে মানুষ বেশি মদ খায়, সে সবও প্রায় বন্ধ। তবুও প্রায় কোনও মদের দোকানেই বিক্রি কমেনি। এমনকি চেনামুখের বাইরেও বহু লোকজন মদ কিনছে বলে দাবি কিছু দোকানির।

কৃষ্ণনগরে ষষ্ঠীতলার মোড়ে এক মদের দোকানের সামনে ঝালবড়া বিক্রি করেন প্রদীপ মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘কয়েক দিন ধরে মদের দোকানে একটু বেশি লোক দেখছি মনে হচ্ছে।’’ তবে তাতে যে ঝালবড়ার বিক্রি বাড়েনি সেটাও জানালেন।’’ এই ভিড় বাড়ার কারণ কী? প্রদীপ উত্তর দিতে যাবেন, তার আগেই পাশ থেকে এক খরিদ্দার জানিয়ে দিলেন, ‘‘কেন আবার, মদ খেলে করোনা হবে না, তাই!’’ লকাই সাহা নামে এক চপের দোকানের কর্মচারী বলেন, ‘‘আমাদের দোকানে অনেক খরিদ্দারই আলোচনা করছে, মদ খেলে করোনা কিছু করতে পারবে না, আমি তো বেশি বেশি মদ খাচ্ছি তাই। হাতও ধুয়ে নিচ্ছি বাংলা মদ দিয়ে।’’

আশ্চর্যের যে অনেক শিক্ষিত মানুষও বিশ্বাস করছেন, মদ খেলে করোনা সংক্রমণ রো‌খা যাবে। কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৌগত বর্মন জানালেন, তাঁর কাছে দেখাতে আসা দু’এক জন প্রসূতির স্বামীও তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, মদ খেলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কিনা। এমনকি কৃষ্ণনগর আদালতের এক উকিলও তাঁকে একই প্রশ্ন করেছেন বলে জানান তিনি।

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের শল্যচিকিৎসক অনির্বাণ জানান, দিন দুই আগে তিনিও এই রকম এক রোগীর পাল্লায় পড়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘মত্ত অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এক যুবক হাসপাতালে এসেছিল। তার ক্ষতে সেলাই দিতে দিতে আমি বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এত মদ খেয়ে সে নিজের সর্বনাশ করছে। সে উল্টে আমায় বুঝিয়ে দেয়, মদই নাকি করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা!

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক আমোদপ্রসাদ যাদব জানান, কয়েক জন রোগী তার কাছে এসেও প্রশ্নটা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মদ খেলে উপকারের বদলে অপকার অনেক বেশি। মদ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, অতিরিক্ত মদ্যপানে হৃৎপিণ্ড বা যকৃতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি হয়। পরিপাকতন্ত্রের ভিতরের দেওয়ালে মিউকাস নির্মিত রক্ষাপ্রাচীর নষ্ট করে দেয় মদ। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।’’

হাত ধোয়া প্রসঙ্গে আমোদপ্রসাদের ব্যাখ্যা, ‘‘ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দূর করতে হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার হিসাবে ৬০% থেকে ৮০% আইসো প্রোফাইল অ্যালকোহলের দ্রবণ কার্যকরী। সে জায়গায় মদের নানা রকমফেরে ৮% থেকে ৪২% ইথাইল অ্যালকোহলের দ্রবণ থাকে। তাতে কোনও হাত ধুলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’’

জাত মাতালেরাও অবিশ্যি তাঁর সঙ্গে সহমত। মদ পেটে চালান করার বদলে হাত ধুয়ে যারা নষ্ট করে, তাঁদের নিয়ে কী করা উচিৎ সেটাই তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না।

এই বোঝা-না বোঝাতেই চলছে রসের কারবার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE