Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
coronavirus

পেশা বদলে বাধ্য, আনাজ বেচছেন সোনার ব্যবসায়ী

অঞ্জন কর্মকার, উত্পল পাল, মদন বিশ্বাস ও শুভ মণ্ডল

অঞ্জন কর্মকার, উত্পল পাল, মদন বিশ্বাস ও শুভ মণ্ডল

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২০ ০১:২৪
Share: Save:

বেশ কিছু দিন সকাল-বিকেল দোকান খুলে বসেছিলেন ওঁরা। কিন্ত মাছি তাড়ানো ছাড়া কোনও কাজ ছিল না। থাকবে কী করে? এই বাজারে সোনার গয়নার খরিদ্দার কোথায়?

বর্তমানে স্বর্ণ-ব্যবসায়ী তথা স্বর্ণ-কারিগরদের রোজগার মাথায় উঠেছে সোনার মূল্যবৃদ্ধি তথা করোনা সংক্রমণের জেরে। অনেকেই উপায় না পেয়ে বিকল্প পেশার পথে হাঁটছেন।

যেমন, গৌতম দাস। যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা-ও শেষ হয়ে গিয়েছে লকডাউনের সময়ে। অগত্যা এক দিন তাই সোনার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে ফলের পসরা নিয়ে বসে পড়তে বাধ্য হলেন। সংসারটা তো চালাতে হবে! এ ছাড়া আর কোনও রাস্তাও খোলা ছিল না তাঁর সামনে।

হতাশ গৌতম দাস বলছেন, “সোনার ব্যবসায় অনেক দিন ধরেই মন্দা দেখা দিয়েছিল। যদিও বা লড়াই করে কোনও মতে টিকে ছিলাম, এ বার করোনার ধাক্কায় সব শেষ হয়ে গেল। জানি না, আর কোনও দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারব কিনা!”

বিক্রি প্রায় ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। কেনার পরিবর্তে অনেকে আসছেন গয়না বিক্রি করতে। আমি মূলত কলকাতা থেকে গয়না বানিয়ে নিয়ে আসতাম। আর শো রুমে তিন জন কারিগর আছেন। তাঁদের মজুরিই উঠছে না এখন। অঞ্জন কর্মকার (একটি গয়নার শো রুমের মালিক)

গল্পটা কম-বেশি অনেকেরই এক রকম। শুধু গৌতমই যে এ ভাবে রাস্তায় নেমে আনাজ বেচতে বাধ্য হয়েছেন, তাই নয়, তাঁর মতো শ’য়ে শ’য়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও স্বর্ণশিল্পী বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজছেন। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্তমানে সোনা-রুপোর ব্যবসায় শুধুমাত্র মন্দা চলছে বললে কিছুই বোঝানো হয় না। বরং, বলা যেতে পারে, মাঝারি ও ছোট ব্যবসা পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে।

একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে। ১০ জন কারিগর ছিলেন আমার দোকানে। তাঁদের মধ্যে ৬ জনকে ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। এখন তাঁদের কেউ টোটো চালাচ্ছেন, কেউ বা রাজমিস্ত্রির কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎপল পাল (স্বর্ণ ব্যবয়াসী)

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ গয়নার ব্যবসা ছেড়ে দোকানে ডিম নিয়ে বসছেন। কেউ ফল বেচছেন। আবার কেউ আনাজের দোকান খুলেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুধু স্বর্ণ কারিগররাই নন, টোটো চালাতে শুরু করেছেন ছোট ছোট সোনা-রুপোর দোকানের মালিকও। শুধু কৃষ্ণনগর শহরেই এমন চার জন স্বর্ণ ব্যবসায়ী টোটো চালাচ্ছেন বলে সংগঠনের কর্তাদের দাবি।

আমি মালিকের কাছ থেকে রুপো নিয়ে এসে বাড়িতে বসে অর্ডার মতো গয়না তৈরি করতাম। মাসে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় ছিল। তিন মাস ধরে কোনও কাজ নেই। পুরো বেকার। জানি না, আগামী দিনেও এই ভাবে ব্যবসা চললে সংসারটা কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখব। মদন বিশ্বাস (কারিগর)

এরই মধ্যে হঠাৎ করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছন্দ্য থেকে অভাবের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে অ্যাসিড খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন এক স্বর্ণব্যবসায়ীর স্ত্রী। সে ঘটনার পরে অনেকেই আশঙ্কিত। এর আগেও নোট বাতিল থেকে শুরু করে নানা সময়ে স্বর্ণ ব্যবসা সঙ্কটের মুখে পড়েছিল। কিন্তু এমন সার্বিক বিপর্যয় আগে কোনও দিন তৈরি হয়নি বলেই জানাচ্ছেন ছোট-বড় সমস্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ী তথা স্বর্ণশিল্পীরা।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশ জুড়ে আর্থিক মন্দার কারণে স্বর্ণ ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বেসরকারি ক্ষেত্রে লাগাতার ছাঁটাই, কর্মহীনতার কারণে একটা বড় অংশের মানুষ শুধু মাত্র সাজসজ্জার কারণে সোনা কেনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। একই সঙ্গে, ছোট ছোট ব্যবসায় বিপর্যয় এমনকি কৃষকদের হাতে টাকা না থাকার কারণে ছোট ও মাঝারি দোকানগুলিতে গয়নার বিক্রি ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকতে শুরু করেছিল।

কিন্তু মাসচারেক আগে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে সেটা চরম আকার নিতে শুরু করে। এক দিকে, একটা বিরাট অংশের মানুষের সংসার চালানোই কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ফলে, শখের বশে সোনা-রুপোর গয়না কেনার ক্ষমতা নেই তাদের। অন্য দিকে, সোনার দাম ক্রমশ আকাশছোঁয়া অবস্থায় পৌঁছে যাওয়ায় তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।

লকডাউনের আগে যেখানে দশ গ্রাম পাকা সোনার দাম ছিল ৪০ থেকে ৪১ হাজার টাকা, সেখানে বর্তমানে তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার টাকা। জেলার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলছেন, “নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি খুব প্রয়োজন না পড়লে গয়নার দোকানমুখো হচ্ছেন না। শখে কেউ আর গয়না কিনছেন না। আর যাঁদের এখনও গয়না কেনার মতো ক্ষমতা আছে তাঁরা আগের মতোই বড় বড় দোকান বা শো-রুমে যাচ্ছেন।”

সব মিলিয়ে ছোট ও মাঝারি দোকানগুলিতে বিক্রি কমতে কমতে প্রায় ২০ শতাংশে নেমে এসেছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। ফলে, সকলেই প্রায় কারিগর ছাঁটাই করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যার জেরে এই ক’দিনে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার স্বর্ণ কারিগর।

করোনা আমাদের পুরো শেষ করে দিয়েছে। লকডাউনের মাঝেই আমরা ৩১ জন বাস ভাড়া করে ফিরে এসেছি। তার পর থেকে একটা টাকাও আয় নেই। সঞ্চয় শেষ। ধার করে কোনও মতে সংসার টিকিয়ে রেখেছি। কাজে ফিরে যাওয়ার পথ খোলা নেই। শুভ মণ্ডল (হায়দরাবাদ ফেরত এক স্বর্ণশিল্পী)

নদিয়া জেলায় সোনার দোকানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন কম-বেশি প্রায় ২২ হাজার মানুষ। এঁদের মধ্যে আছেন মালিক থেকে শুরু করে ছোট-বড় নানা ধরনের কারিগর। এর মধ্যে একটা বড় অংশ রুপোর কারিগর, যারা দোকানে বসে কাজ না করে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রুপো নিয়ে গিয়ে বাড়িতে বসে গয়না তৈরি করে। এঁদের অবস্থাও এই মুহূর্তে একই রকম।

সঙ্কটের মুখে রানাঘাটের সোনার পাইকারি ব্যবসায়ীরাও। অখিল ভারত স্বর্ণকার সমিতির রাজ্য কমিটির কার্যকারী সম্পাদক অক্ষয় ভট্টাচার্য বলেন, “করোনার ধাক্কায় গোটা শিল্পটাই চরম সঙ্কটের মুখে। এই ধাক্কা সামলানোর মতো কোনও পথ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যাঙ্কগুলো কোনও ঋণ দিচ্ছে না। জানি না, আগামী দিনে আমাদের জন্য কী অবস্থা অপেক্ষা করে আছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Corona COVID-19 CoronavIrus Lockdown Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE