কথায় আছে, যত হাসি তত কান্না...
কিন্তু কালী কি হাসতে পারে? ও তো নাচছিল! ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় তারও বুঝি পুলক জেগেছিল। সেই হাওয়া কি তার কানে কানে
কিছু বলেছিল?
নদিয়ার চেঁচানিয়ার অমর মণ্ডল গোমড়া মুখে বলছেন, “অতশত বুঝি না মশাই! ওর ওই পুলকের কারণে আজ প্রায় এক হপ্তা ধরে বিএসএফ ক্যাম্প, থানা আর আদালত ঘুরে ঘুরে মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড়।"
ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন অমরের মা মিনতি, “ও ভাবে বলিস না বাছা। কালী তো অবলা। ও কি জেনেশুনে এ সব করেছে?”
কথাটা ঠিক। কালীর অত জ্ঞানগম্যি নেই। বাড়ির এক্কেবারে কাছেই হাঁটুজল পদ্মা। সেটাই সীমান্ত। বিএসএফের চোখে সেটাই ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। রবিবার কাকভোরে কালীর কী হয়েছিল কে জানে! রোজ দিন এমনটা করে না। গোয়াল থেকে বের করে অমরই তাকে বেঁধে রাখে নির্দিষ্ট জায়গায়। কিন্তু সে দিন ঘর থেকে বেরোনোর পরেই অমরের কথার বাগ মানছিল না কালী। দড়ি ছিঁড়ে এমন ভাবে নাচছিল যেন সোনামণির বে!
অমর ধরতে যেতেই সে দিল ছুট। গোয়াল, উঠোন, সদর দরজা পেরিয়ে পাট খেত ভেঙে সে ছুটল শীর্ণ পদ্মার দিকে। বাইনোকুলারে চোখ রেখে বিএসএফের এক জওয়ান দেখলেন, পদ্মার দিকে ছুটছে একটি গরু। পিছুপিছু ছুটছেন এক যুবক। এ দৃশ্য তার চেনা। তিনি ভাবছেন, পাট খেতের আড়ালে কি আরও গরু আছে? বার্তা গেল ওয়াকিটকিতে। চকিতে রাতজাগা সীমান্ত ফের টানটান হয়ে উঠল। সীমানা পেরোনোর আগেই জওয়ানদের হাতে ধরা পড়ে গেল বেচারা কালী। তাকে নিয়ে যাওয়া হল বাউসমারি ক্যাম্পে। পিছুপিছু গেলেন অমরও। বিএসএফ অফিসারের কাছে তাঁর করুণ আর্তি, “ও সাহেব, ইয়ে হামারা পোষা গরু কালী হ্যায়। এই দেখুন, ম্যায় ডাকলে ও সাড়াও দেগা। কালী, অ্যাই কালী...।” কালী শুধু এক বার অমরের দিকে তাকালো। তারপর ফের মন দিল ক্যাম্পের কচি ঘাসে। এ দিকে বিএসএফের স্পষ্ট জবাব, রবিবার রাতে তারা তাড়া করে গরু পাচার রুখেছে। এ গরুও নির্ঘাত পাচার করা হচ্ছিল। না হলে ও ভাবে সীমান্তের দিকে ছুটছিল কেন?
খবর পেয়ে ক্যাম্পে এলেন স্থানীয় লোকজন, গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য। কিন্তু চিড়ে ভিজল না। গরু গেল পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়ার এক খোয়াড়ে আর গরু বাজেয়াপ্ত করার কাগজপত্র গেল স্থানীয় হোগলবেড়িয়া থানায়। অমর বলছেন, “কী ফ্যাসাদ বলুন তো? কালী দেড় সের করে দুধ দেয়। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা ও বাচ্চা আছে। দুধ ছাড়া তাদের চলে না। এ দিকে কালী তো পড়ে রয়েছে খোয়াড়ে। নিরুপায় হয়ে কালীকে ছাড়ানোর জন্য তেহট্ট আদালতে উকিল ধরলাম।" তেহট্ট আদালতের আইনজীবী গোলাম রাব্বি বলছেন, “মামলা উঠেছিল তেহট্ট মহকুমাশাসকের আদালতে। আদালত অমরবাবুকে গরু ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।’’
কাছারিপাড়ার বাসিন্দা তথা মধুগাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সিপিএমের শঙ্কর মণ্ডল বলছেন, “বছর দশ-বারো আগে কালীর মতোই একই হাল হয়েছিল জোয়ারদার বাড়ির চন্দনার। সে বারেও আইন আদালত উকিল ধরে চন্দনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সীমান্তে বাস করলে কতরকম ঝক্কি যে পোহাতে হয়!”
শুক্রবার সন্ধ্যায় বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঘরের কালী ঘরে ফিরেছে। এই কদিনে তার হাড় যেন গোনা যাচ্ছে। অমরের মা মিনতি গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কালীকে খাওয়াচ্ছেন খোল আর খড়। পাশে দাঁড়িয়ে অমর বিড়বিড় করছেন, “কেমন কপাল দেখুন! ছিলাম কালীর মালিক। আইনের মারপ্যাঁচে হয়ে গেলাম জিম্মাদার। আর কালীটাও এক্কেবারে গরু। নেত্য করার যখন এতই ইচ্ছে পাড়ার মধ্যেই করতে পারত। পদ্মার দিকে যাওয়ার কী দরকার ছিল? কী রে, আর কখনও যাবি?” খড় থেকে মুখ তুলে কালী ডাকল—হাম্বা!
সহ-প্রতিবেদক: কল্লোল প্রামাণিক
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy