কয়েক বছর আগেও দেখা যেত সেই দৃশ্য।
গায়ে ফুলহাতা কালো রঙের জামা। গলার বোতাম পর্যন্ত আঁটা। তাঁর সঙ্গে থাকা সাইকেলটিও অদ্ভুতদর্শন। সাইকেলের দু’ হাতল থেকে ঝুলছে ফেলে দেওয়া ক্যাসেটের রিল। হাতলের দু’দিকে ছোট দু’টি আয়না। মাথায় সাদা টুপি। পায়ে ম্যাচিং জুতো। সস্তার রোদচশমা চোখে বছর বত্রিশের এক যুবক দুই কিশোরকে নিয়ে হাজির জিয়াগঞ্জের বিএসএ মাঠে। মাঠে তখন খেলছে ছেলেপুলেরা। হঠাৎ বাজখাঁই গলার এক যুবককে দেখে থেমে গেল খেলা।
ওই যুবক তখন হাঁক দিচ্ছেন, ‘দাদারা,দিদিরা আমার ছোট ছোট ভাইয়েরা। আমার নাম সাবির মিঞা। আমি আসছি সেই সুল-ল-ল-ল-তানপুর থেকে। আমি আপনাদের সাইকেলের খেলা দেখাব। এ খেলা দেখতে কোনও পয়সা লাগবেনা। আসুন খেলা দেখুন। বিনি পয়সায় মজা নিন।’’ বলেই হাতের ব্যাগটি সঙ্গের এক কিশোরের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। তারপর চলতে শুরু করল সাইকেল। প্যাডলে উঠে একবার দু’ হাত ছেড়ে দিচ্ছেন সাবির। কখনও দু’ পা তুলে দিচ্ছেন সাইকেলের হ্যান্ডলের ওপর। তা দেখে হাততালি থামতেই চায়না খুদেদের।
এখনও বিকেল হলেই জিয়াগঞ্জের মাঠে খেলে বেড়ায় বাচ্চারা। এখনও তাদের চোখ খুঁজে বেড়ায় সাবির মিঞাকে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে যিনি আসতেন সেই ইকবাল শেখের হাত আর খেলা করে না সাইকেলের হ্যান্ডলে। কয়েক বছর আগে হাতে রাজমিস্ত্রির করণিক তুলে নিয়েছেন তিনি। দু’ বছর আগে মারহা গিয়েছেন সাবিরও। ইকবাল এদিন বললেন, ‘‘অন্য পেশায় না গিয়ে উপায় ছিল না। সাইকেলের খেলা দেখিয়ে পেট চলছিল না। খেলা দেখতে ভিড় হত ঠিকই। কিন্তু টাকা সব দর্শক দিতেন না। আর চলছিল না’’
স্মৃতি হাতড়ে ইকবাল পুরনো দিনের অনেক কথা জানালেন। একবার সাবির মিঞা খেলা দেখাচ্ছিলেন জিয়াগঞ্জ হাটের মাঠে। তাঁর চোখ বাঁধা। ওই অবস্থায় তিনি একজনকে বললেন একশো টাকার নোট হাতে নিয়ে মাঠের এক কোণে দাঁড়াতে। একবার চোখের কাপড় খুলে শুধু দেখে নিয়েছিলেন কোথায় দাঁড়িয়ে ওই ব্যক্তি। তারপর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সাইকেল চালিয়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে নোটটা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সে ‘কেরামতি’ আজও ভোলেনি জিয়াগঞ্জ। প্রতিবার খেলা চলাকালীন সাবির মিঞা দর্শকের মধ্যে কাউকে ডেকে নিতেন। তারপর নুনের প্যাকেট এবং একটা কালো কাপড় তাঁর হাতে ধরিয়ে দিতেন। এরপর সাবির বলতেন, ‘‘আমি চোখ বন্ধ করছি। আপনি আমার চোখের ওপর ওই নুনের পট্টি ভাল করে বেঁধে দিন।’’ ওইভাবে চোখবাঁধা অবস্থায় হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতেন তিনি।
জিয়াগঞ্জের বাসিন্দা বছর ষাটের শ্যামসুন্দর সরকার বলছিলেন, ‘‘সেই সাইকেল নিয়ে খেলা দেখানোর লোক আজ কোথায়। জিয়াগঞ্জে কোনওদিন বড় সার্কাস হয়নি। সাইকেল খেলা দেখতে ভিড় হত খুব। শেষের দিকে সাবির বলে ওই যুবক কয়েকবার এসেছিল। এখন তো আর ওকেও দেখি না’’ জিয়াগঞ্জ বোঝে, সাইকেলের হ্যান্ডলে হাত রেখে সংসার চালানোটা বড্ড ঝুঁকির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy