Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Cyclone Amphan

হরি লুটের টাকা ঘরে ফেরাবে কে  

বহু সম্পন্ন পরিবার যাদের পাকাবাড়ি আছে এমন অনেকেই টাকা পেয়েছে। এমন অনেকে টাকা পেয়েছেন যাঁদের বাড়ি দোতলা।

টাকা ফেরানোর রসিদ। —নিজস্ব চিত্র

টাকা ফেরানোর রসিদ। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২০ ০০:৪৯
Share: Save:

আমপানের ত্রাণ নিয়ে মাত্রাছাড়া দুর্নীতিতে বেকায়দায় পড়ে শাসক দলের নেতারা এখন টাকা ফেরত দেওয়ার তোড়জোড় চালাচ্ছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে অযোগ্য প্রাপকদের হাতে চলে যাওয়া সেই টাকার কতটা সত্যিই ফেরানো সম্ভব তা নিয়ে প্রশাসনের কর্তাদেরই সন্দেহ আছে।

গত ২০ মে আমপান ঘূর্ণীঝড়ে নদিয়ার মূলত কল্যাণী ও রানাঘাট মহকুমায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে। ফসলের ক্ষতি হয়। রাজ্য সরকারের নির্দেশে ঝড়ের দু’দিনের মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তর থেকে ব্লক হয়ে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা পৌঁছয় অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাসের দফতরে। সেই তালিকা অনুযায়ী ঘর বানানোর অনুদান সপ্তাহখানেকের মধ্যে ব্লকস্তরে চলে আসে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আবেদনকারীদের অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হয়।

এত তাড়াহুড়ো করার পরে দেখা যায়, বহু সম্পন্ন পরিবার যাদের পাকাবাড়ি আছে এমন অনেকেই টাকা পেয়েছে। এমন অনেকে টাকা পেয়েছেন যাঁদের বাড়ি দোতলা। এঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই রয়েছে শাসক দলের নিবিড় যোগাযোগ। তাঁরা কেউ তৃণমূলের টিকিটে জয়ী জনপ্রতিনিধি, কেউ বা দলের গ্রাম বা ব্লক স্তরের নেতা। জেলাশাসক এবং বিডিও-দের দফতরে ভূরি ভূরি অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করে। কিন্তু তত দিনে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ জমা পড়ার আগেই বেশিরভাগ আবেদনকারী টাকা পেয়ে গিয়েছেন।

এখন জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তা মেনে নিচ্ছেন, আমপান ঝড়ে নদিয়ায় আদৌ হাজার-হাজার লোকের ঘর ভাঙেনি। ঘর ভাঙা ও ফসল বাবদ কোটি-কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে পঞ্চায়েতগুলি রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। জেলায় মোট ১৮৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, তার মধ্যে কিছু-কিছু পঞ্চায়েত বিভিন্ন বিষয়ে তালিকা তৈরি করেই রাখে। চাইলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, ত্রাণের নামে কার্যত ‘হরির লুট’ হয়েছে। সেই লুট হওয়া ওই টাকা উদ্ধার করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কল্যাণীর বিডিও দীপ চট্টোপাধ্যায় জানান, এখন ব্লক অফিসের তরফে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অনেক অযোগ্য লোকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লোকজনকে বলা হচ্ছে, সরকারি টাকা অন্যায় ভাবে নেওয়া কতটা অন্যায়। এখনও পর্যন্ত ছ’জন টাকা ফেরত দিয়েছেন। তৃণমূলের কল্যাণী ব্লক সভাপতি পঙ্কজকুমার সিংহ বলেন, “আমার এলাকায় যারা আমপানের ক্ষতিপূরণের টাকা নয়ছয় করেছে দল তাদের পাশে নেই।“

কৃষ্ণনগর ২ ব্লকেও গত কয়েক দিন ধরে ক্ষতিপূরণ বিলি নিয়ে ইতিউতি বিক্ষোভ হচ্ছিল। চাপ বাড়ছিল শাসকদলের উপর। বৃহস্পতিবার সেখানকার নওপাড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৭ জন ও নওপাড়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছ’জন টাকা ফেরত দিয়েছেন। পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ বদর শেখ বলছেন, “এ ব্যাপারে দলের বার্তা পরিষ্কার। টাকা ফেরত দিতে হবে। সেই মতো টাকা ফেরত দিয়েছি আমরা।“ কৃষ্ণনগর ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “প্রশাসন আবেদনপত্র যাচাই না করেই বড়লোকদের টাকা দিয়েছে। এর সঙ্গে দলের যারা জড়িত তারা তো টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করেছে। ওই সব নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দল পরে কড়া পদক্ষেপ করবে।“ যদিও যে ভাবে নানা আত্মীয়স্বজনের নামে টাকা বার করে নেওয়া হয়েছে, তার অর্ধেক ফেরানোও যে যথেষ্ট কঠিন কাজ তা জেলা তৃণমূল নেতারা ভাল ভাবেই জানেন।

তবে বদরের অভিযোগ, কংগ্রেসের জেলা কমিটির নেতা আইনজীবী আব্দুর রহিম শেখের ভাইয়ের স্ত্রীও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অথচ তাঁর ঘর ভাঙেনি। বদর বলেন, “ওঁর ভাইয়ের বাড়ি আমার গ্রামে। প্রশাসন বা কোনও তৃণমূল নেতার সঙ্গে যোগসাজশে ওঁরা এটা করেছেন। ওই টাকা ফেরত না দিলে তৃণমূল কিন্তু ছেড়ে দেবে না।“ রহিমের পাল্টা দাবি, “আমার সঙ্গে আমার ভাইয়ের গত ছ’বছর ধরে কোনও সম্পর্ক নেই। ভাই বদরেরই ঘনিষ্ট। ফলে ওই টাকা ফেরানোর দায়িত্ব বদরকেই নিতে হবে।“ জেলার একাধিক বিডিও জানাচ্ছেন, এখন লোকজনকে অনুরোধ করা হচ্ছে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। রাজনৈতিক নেতাদেরও চাপ দেওয়া হচ্ছে। নবান্ন থেকে তদন্তকারী দল বিভিন্ন ব্লকে এসে দেখছে, ঠিক লোক টাকা পেয়েছে কিনা। ‘পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি’ আইনে টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কি না, সে বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। কেউ ভুয়ো নথি দিয়ে আবেদন করে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করলে তা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তাঁকে হাজির করিয়ে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা যেতে পারে।

তবে প্রশাসনের আশঙ্কা, আইনি পথে যেতে গেলে যে শত-শত লোকের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে তাতে মহকুমাশাসকের অফিসে অন্য কাজ মাথায় উঠবে। বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কটাক্ষ, “তৃণমূল নেতারা ত্রাণের ৯০ শতাংশ টাকাই আত্মসাৎ করেছেন। এ সব টাকা ফেরানো লোক দেখানো নাটক ছাড়া কিছুই নয়!”

প্রশাসন আর দলের তরফে নীচতলার নেতাদের চাপ দিয়ে শাসক দল আমপানের কড়ি যোগ্য হাতে ফেরাতে পারে কি না, তার উপরে কিন্তু ভোটের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan Corruption TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE