যানজটে স্তব্ধ পথ। — নিজস্ব চিত্র
স্টেশন থেকে নেমে শহরে পা দিতেই শুরু ভোগান্তি। সঙ্কীর্ণ সব রাস্তায় ছোট-বাড়ির লম্বা সারি। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর ধীরে ধীরে সচল হয় গাড়ির চাকার। সকাল থেকে রাত প্রায় ১০টা অবধি রানাঘাট শহরে এমনই যানজটের শিকার হতে হয় পথচারীদের।
দু’টো গাড়ি পাশাপাশি চলে এলে রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। দু’টো গাড়িই নড়তে বেশ খানিকক্ষণ সময় নেয়। ততক্ষণে সামনে-পিছনে দাঁড়িয়ে যায় ম্যাটাডোর, টুকটুক, ভ্যান, রিকশা, মোটরবাইক-সহ বিভিন্ন গাড়ি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে লেগে যায় কমপক্ষে পনেরো মিনিট। নাগরিকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিনের এই পথ-যন্ত্রণা কমাতে প্রশাসনের তরফ থেকে কখনও কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করা হয় না।
রবিবার দুপুরে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে যানজটজনিত ভোগান্তির চিত্রটা চোখে পড়ল। দেড়শো বছরের পুরনো রানাঘাট পুর এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা জিএনপিসি রোডে দেখা গেল ভরদুপুরেও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি। গাড়ির আধিক্যে রাস্তার পাশ মাছি গলার জায়গা নেই। পথচারীরাও গাড়ির সারির পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরাও এক পাও এগোতে পারছেন না। জেলা জুড়ে চলছে পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ। এই সপ্তাহেও শহরের যান নিয়ন্ত্রণের কোনও বালাই নেই। রানাঘাট রেল স্টেশনের-১ নম্বর প্লাটফর্মের জিআরপি এবং হলকামরা গেট বেরোলেই মূল শহরে পা পড়ে। দিনভর হাজার হাজার মানুষ ট্রেন থেকে নেমে জিআরপি গেট দিয়ে বেরিয়ে শহরে ঢোকেন। তারপরই শুরু হয় সমস্যা। যে রাস্তাতেই যান না কেন যানজট পিছু ছাড়ে না। শহরের জিএনপিসি রোড, সুভাষ এভিনিউ, স্বামী বিবেকানন্দ সরণীতে যানজট মাত্রাছাড়া। শুধু এই রাস্তাগুলিই নয় শহরের প্রায় সর্বত্রই একই চিত্র। নির্বিঘ্নে কোনও রাস্তা দিয়েই লোকজন চলাফেরা করতে পারে না। ব্যস্ত সময়ে চলাফেরা তো দূরের কথা, গাড়ির ঠেলায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়ে। বিবেকানন্দ সরণিতে এ দিন আটকে পড়েন শুক্লা বিশ্বাস নামে মাঝবয়সী এক মহিলা। রোদে-গরমে ক্লান্ত মহিলা বললেন, ‘‘এতো রোজকারের কষ্ট। রাস্তায় বেরোতেই ভয় লাগে। এত রোদে যানজটে এ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজন অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে পড়ছেন।’’
এরই মধ্যে শহরের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা কেটে জলের পাইপ বসানো হচ্ছে। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো। কারণ, ওই সব রাস্তাগুলির সামনে বোর্ড ঝোলানো হয়েছে—‘‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য রাস্তা বন্ধ।’’ ফলে অন্য রাস্তাগুলিতে লোকজন ও গাড়ির ভিড় আরও বাড়ছে। সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে যানজট ও লোকজনের যন্ত্রণা। অ্যাম্বুল্যান্স চালক বাপ্পা মণ্ডল বলেন, “আমরা সময় মতো রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারি না। রানাঘাট মহকুমার হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে শহরের বাইরের রাস্তা ধরতে হয়। তা যদি কালেভদ্রে কখনও সম্ভব না হয়, তাহলে আর রক্ষা থাকে না। যানজটে আটকে সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছনো যায় না। এ দিকে রোগীর বাড়ির লোকজন লাগাতার তাড়া দিতে থাকেন। তখন নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হয়। কিন্তু, আমাদের কিছু করার থাকে না।”
শহরবাসীর দাবি, রাস্তার দু’ধারে ফুটপথ দখল করে গজিয়ে উঠেছে অগুন্তি দোকানপাট। সেই তালিকায় চা-বিড়ির গুমটি যেমন রয়েছে তেমন আছে জুতো-জামা-কাপড়ের কংক্রিটের দোকানও। এরই মধ্যে যাত্রী তোলার জন্য যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে টোটো। পুরসভার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শহরে প্রায় ১৩০০টি অনুমোদনপ্রাপ্ত ভ্যান ও রিকশা রয়েছে। কিন্তু, আদতে শহর জুড়ে চলছে কমপক্ষে হাজার পাঁচেক ভ্যান ও রিকশা। এর মধ্যেই দিন দিনে বাড়ছে টোটোর সংখ্যা। শহরে এই মুহূর্তে টোটো চলে প্রায় ৭০০টি। এছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শহরে আরও ঢুকছে হাজার খানেক টোটো। এ সব টোটো শহরে যানজট বাড়াচ্ছে।
রানাঘাট শহরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রুটের ৬০টি বাস চলে। স্বামী বিবেকানন্দ সরণি হয়ে এই বাসগুলো যায় কোর্ট মোড়ে। সেখান থেকে ফুলিয়া, শান্তিপুর হয়ে বাসগুলির অধিকাংশ যায় কালনাঘাটে। কিছু বাস হবিবপুর, তারাপুর, নপাড়া হয়ে বলাগড়ঘাটে পৌঁছয়। এ ছাড়াও হবিবপুর, শান্তিপুর হয়ে বাগাআঁচড়া রুটের বাসও চলে শহরের মধ্য দিয়ে। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে এই বাসগুলি। শহরের যে সব রাস্তা দিয়ে ওই বাসগুলি যাতায়াত করে সেগুলিতে প্রবল যানজট তৈরি হয়। নাভিশ্বাস ওঠে বাসচালকদেরও। এক বাসচালক বললেন, “রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে রিকশা-ভ্যান-টোটো। আবার কোথাও রাস্তাতেই লরিগুলি মাল খালাস করে।’’ যানজটের জন্য সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দমকল বাহিনীকেও। রথতলা রেলগেটের কাছে দমকলের কার্যালয়। কোথাও কোনও দুর্ঘটনার খবর পেলে সাধারণত দমকলের গাড়ি রথতলা ও চাবি রেলগেট পার হয়ে ঘটনাস্থলে যায়। দমকল বাহিনীর এক আধিকারিক বলেন, “রাস্তায় বেরোলেই কোনও না কোনও যানবাহন এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বিশেষ করে টোটো।’’ সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রানাঘাট পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তাগুলো সংকীর্ণ। রাস্তার দু’ধারে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। যার জন্য সমস্যা হচ্ছে। তবে পুরকর্মীরা যানজটকে মাত্রা ছাড়াতে দেন না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy