বাড়িতে কার্তিকের স্ত্রী ও মেয়ে। নিজস্ব চিত্র
শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে বেশি রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন ডাক্তারবাবু। সঙ্গে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী এক যুবক। গাড়ি রেখে ফটক পেরিয়ে দু’জনে হেঁটে বাড়িতে ঢোকার সময়েই পিছন থেকে ছুটে আসে গুলি।
আততায়ীর মাথায় ছিল হেলমেট। প্রথম গুলিটা লাগেনি। মুখ ঘুরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ওঁচানো আততায়ীকে দেখে দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন ডাক্তারের সঙ্গী। পরপর তিনটি গুলি তাঁকে মাঝ পথেই শুইয়ে দেয়।
মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টা নাগাদ কৃষ্ণনগরের চুনুরিপাড়া লেনে মেডিসিনের চিকিৎসক কুমুদরঞ্জন বিশ্বাসের বাড়িতে ঘটনাটি ঘটে। নিহত কার্তিক বিশ্বাসের (৩৪) বাড়ি ওই পাড়াতেই। প্রথমে হতচকিত হয়ে গেলেও পরে এলাকার লোকজনের রাগ গিয়ে পড়ে ডাক্তারবাবুর উপরে।
বুধবার সকাল থেকে চিকিৎসকের বাড়িতে দফায়-দফায় হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। পুলিশ গেলে তাদের লক্ষ করে বোমাও ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ পাল্টা লাঠি চালায়। তাতে চোট পান কার্তিকের বোন। দুপুরে চিকিৎসক ও তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। তবে চিকিৎসকের দুই ছেলে, গাড়ির চালক এবং এক ওষুধের দালালকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওই চার জন ছাড়া চিকিৎসকেরও নামে অভিযোগ দায়ের করেছে নিহতের পরিবার।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরেই কুমুদরঞ্জনের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন কার্তিক। বিভিন্ন ওষুধ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ তিনিই বজায় রাখতেন। তাতে মোটা টাকা কমিশনও মিলত। কুমুদরঞ্জনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সম্পত্তির অনেকটা হিসাব তিনিই রাখতেন।
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, তিন জন ওষুধের দালাল কুমুদরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁদের অন্যতম কার্তিক মূলত ব্যক্তিগত চেম্বার থেকে হওয়া প্রেসক্রিপশনের ওষুধের কমিশনের বিষয়টি দেখতেন। আর এক জন দেখতেন জেলা হাসপাতালের ওষুধের কমিশন সংক্রান্ত বিষয়টি। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক হয়ে গেলে দ্বিতীয় জনের আয় কিছুটা কমে যায়। তিনি তখন চিকিৎসকের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন, চেম্বারের কমিশনও যাতে তিনি খানিক পান। এ নিয়ে মাস ছয়েক আগে ডাক্তারের সামনেই কার্তিকের সঙ্গে তাঁর বচসা বেধে গিয়েছিল।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, কুমুদরঞ্জন বেশি ভরসা করতে থাকায় তাঁর ছেলেদেরও কুনজরে পড়েছিলেন কার্তিক। তাঁরা থাকতে কার্তিকের হাতে কেন সব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে চিকিৎসকের ছোট ছেলে অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন। ফলে দু’দিক দিয়েই কার্তিকের শত্রু তৈরি হচ্ছিল। তার জেরেই এই খুন।
পুলিশ সূত্রের খবর, হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে রোজকার মতো গাড়িতে কার্তিককে নিয়েই ফেরেন কুমুদরঞ্জন। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ঢোকার সময়ে কার্তিক সামনে ছিলেন। চিকিৎসকের পিছন থেকে আততায়ী প্রথম গুলিটা ছোড়ে। সেটা লাগেনি। কার্তিক ছুটে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলে ধাওয়া করে হেলমেট পরা লোকটি। পরপর দু’টি গুলি খেয়ে কার্তিক পড়ে যান। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁর মুখে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে চিকিৎসকের পাশ দিয়েই ছুটে পালিয়ে যায় আততায়ী।
পুলিশের দাবি, ঘটনার অনেকটাই বাড়ির সামনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে। কুমুদরঞ্জনের কথায়, “গোটা ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। আমি ছেলেটাকে বাধা দিতে গেলে আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে চলে যায়।” মাথায় হেলমেট থাকায় তিনি মুখ চিনতে পারেননি বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছেন। যদিও নিহতের পরিবার ও পাড়া-পড়শিদের একাংশের অভিযোগ, চিকিৎসক ঠিকই দুষ্কৃতীকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু কাছের লোক হওয়ায় তাকে বাঁচাতে মিথ্যে কথা বলছেন।
মোটে বছর তিনেক আগে বিয়ে হয়েছিল কার্তিকের। বছর দুয়েকের একটি মেয়েও আছে। তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বিশ্বাসের অভিযোগ, “ডাক্তারবাবু আমার স্বামীকে খুব ভালবাসতেন। টাকাপয়সার হিসেব রাখতে দিতেন। ওঁর ছোট ছেলে সেটাই মানতে পারেনি।” জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার শুধু বলেন, “পুরনো কোনও শত্রুতার জেরে এই খুন। তদন্তে সবটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy