Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Murder

মোটরবাইক চোখেই পড়েনি গাড়ি চালকের

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই গাড়ি থেকে নেমে চিকিৎসকের বাড়িতে ঢোকার সময়েই পিছন থেকে ছুটে এসে কার্তিককে পরপর গুলি করে আততায়ী। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছে।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:২২
Share: Save:

কার্তিক খুনের আগে-পরে চিকিৎসক কুমুদরঞ্জন বিশ্বাসের বাড়ির আশপাশে কোনও মোটরবাইক তাঁর চোখে পড়েনি বলে দাবি করলেন গাড়ির চালক দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে গোবিন্দ। অথচ তার কিছু ক্ষণ আগেই শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে মোটরবাইকে চিকিৎসকের গাড়ির পিছু ধাওয়া করতে দেখা গিয়েছিল লাল হেলমেট পরা আততায়ীকে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই গাড়ি থেকে নেমে চিকিৎসকের বাড়িতে ঢোকার সময়েই পিছন থেকে ছুটে এসে কার্তিককে পরপর গুলি করে আততায়ী। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কিন্তু পুলিশ আততায়ীকে ধরতে পারেনি। খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত অভিযোগে সাগর নাথ এবং পিন্টু ভট্টাচার্য নামে যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আজ, শুক্রবার তাদের ফের কৃষ্ণনগর আদালতে তোলার কথা। বিচারক যদি তাদের জেল হেফাজতে পাঠান, পুলিশের পক্ষে আর তাদের জেরা করা সহজ হবে না।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, গাড়িটা অনন্তহরি মিত্র রোড থেকে ডান দিকে বেঁকে কুমুদরঞ্জন বিশ্বাসের বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। চিকিৎসক আর তাঁর সঙ্গী কার্তিক বিশ্বাস নেমে গেলে গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তার পরেই আততায়ী পিছন থেকে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ঢোকে। সম্ভবত তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার তোড়জোড় করছিলেন গোবিন্দ। গেটের সামনে হেডলাইটের আলো পড়ে। খুনি কোমরের পিছনে পিস্তল গুঁজে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই গাড়িটিকে ধীর গতিতে ফিরে যেতে দেখা যায়।

প্রশ্ন হল: ১) আততায়ী যদি তিন কিলোমিটার দূরের হাসপাতাল থেকে গাড়িটিকে ধাওয়া করে আসে, চালক ‘রেয়ার ভিউ মিরর’-এ তাকে দেখতে পেলেন না কেন? বিশেষ করে রাতের ফাঁকা রাস্তায়? ২) আততায়ী যদি গাড়ির পিছনে বাইক থামিয়ে বাড়িতে ঢুকত, তা হলে ফেরার সময়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে তার ডান দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে গিয়েছে বাঁ দিকে, অর্থাৎ যে দিক থেকে গাড়ি ঘুরে ফিরে আসছে। তা হলে কি কোনও সময়ে সে গাড়িকে ‘ওভারটেক’ করে সামনে চলে গিয়েছিল? ৩) এত কাছে চারটি গুলির শব্দ হল অথচ চালক গাড়ি থেকে নেমে খোঁজ নিতে এলেন না কেন? ৪) তিনি কি আততায়ী বা তার মোটরবাইকটি দেখতে পেয়েছিলেন?

তদন্তে নেমে গোবিন্দকেও আটক করে দফায়-দফায় জেরা করেছিল পুলিশ। চিকিৎসক ছাড়া তিনিই এক মাত্র প্রত্যক্ষদর্শী যিনি ঘটনার কিছুটা হলেও দেখেছেন। কুমুদরঞ্জনকে এ পর্যন্ত থানায় ডেকে জেরা করা হয়নি। গোবিন্দকে জেরা করা হলেও ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ না মেলায় পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারকে গোবিন্দ জানান, কুমুদরঞ্জনের নিজস্ব কোন গাড়ি নেই। সাধারণত তিনি কার্তিকের মোটরবাইকেই বাড়ি থেকে হাসপাতালে যাতায়াত করতেন। তবে শরীর খারাপ থাকলে শহরের এক প্রতিষ্ঠিত প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবের মালিকের গাড়ি চেয়ে নিতেন। মাস কয়েক ধরে টানা অসুস্থতার কারণে তিনি প্রায় দিনই গাড়ি নিচ্ছিলেন। সেই গাড়ির চালক গোবিন্দ।

গোবিন্দের দাবি: ১) হাসপাতাল থেকে ফেরার সময়ে গাড়ির পিছনে কোনও মোটরবাইককে ধাওয়া করতে দেখেননি তিনি। দৈবাৎ চোখে পড়ে থাকলেও খেয়াল করেননি। ২) কোনও মোটরবাইককে ‘ওভারটেক’ করতেও দেখেননি তিনি। ৩) গুলির শব্দ তিনি পেয়েছিলেন। গোবিন্দের কথায়, “গাড়িটা ঘুরিয়ে আনার জন্য কিছুটা এগোতেই পরপর শব্দ শুনি। গাড়িতে এসি চলায় সব জানালার কাচ তোলা ছিল। আমি ভেবেছিলাম, ছেলেরা মাঠে পিকনিক করছে, তাই পটকা ফাটাচ্ছে।” ৪) গাড়ি ঘুরিয়ে যখন ফিরছেন, ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে হেলমেট পরা এক জনকে তিনি হাত তিনেক দূর দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেন। তার পরেও তাঁর কিছু মনে হল না? গোবিন্দের বক্তব্য, ‘‘অনেক সময়েই রোগীর বাড়ির লোক রাতে ডাক্তারবাবু হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে রিপোর্ট দেখানোর জন্য এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ভেবেছিলাম, তেমনই কেউ।”

তাঁর সন্দেহ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে গোবিন্দের আরও যুক্তি, ‘‘এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও চিকিৎসক বা তাঁর পরিবারের কেউ চিৎকার-চেঁচামেচি করেননি। তাই আমি কিছু বুঝতেও পারিনি। গাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়েছি।’’ গোটা বিষয়টি তিনি পুলিশকেও জানিয়েছেন বলে গোবিন্দের দাবি।

কিন্তু কোনও মোটরবাইক কেন গোবিন্দের চোখে পড়ল না, সেই প্রশ্ন তদন্তকারীদেরও ভাবাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মোটরবাইক যদি ‘ওভারটেক’ করে না থাকে তা হলে খুনি কাজ সেরে বাঁ দিকে, অর্থাৎ সামনের দিকে গেল কেন সেই প্রশ্নেরও নিষ্পত্তি হয়নি। পুলিশের একাংশের সন্দেহ: তবে কি হাসপাতালের গেট থেকে বেরনোর পরে সোজা রাস্তা ছেড়ে অন্য কোনও ‘শর্টকাট’ দিয়ে এসে বাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিল আততায়ী? সে যদি শহরের বাইরে থেকে ভাড়া করে আনা খুনি হয়, তবে সেই ছোট রাস্তা সে চিনল কী করে? তাকে কি আগেই রাস্তা চিনিয়ে রাখা হয়েছিল, নাকি ঘটনাস্থলে তার সঙ্গে স্থানীয় কেউ ছিল, যে কাছাকাছি মোটরবাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিল?

পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ধৃত ওষুধের স্টকিস্ট পিন্টু ভট্টাচার্যেরই মোটরবাইকে এসেছিল খুনি। এবং কাজ সারার পরে পিন্টুই তাকে বাইকে চড়িয়ে হাইরোডে পৌঁছে দিয়ে আসে। তা সত্ত্বেও পুলিশ পিন্টুর মুখ থেকে খুনির নাম বার করতে পারেনি, এটা কার্তিকের পরিবারও বিশ্বাস করতে নারাজ। তাঁদের প্রশ্ন, তবে কি কাউকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে? ‘তদন্তের স্বার্থে’ পুলিশকর্তারা ‘তদন্ত চলছে’র বেশি আর কিছুই অবশ্য বলছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Bike CCTV
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE