Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জল ঢালুক দোকানি, আড্ডা চলবে

রোজ দুপুর ১২টায় পরীক্ষা শুরু হয়। ছেলেমেয়েরা তার আগেই গুটি-গুটি পায়ে ঢুকে পড়ে স্কুলের ভিতরে। তার আগে ‘ভাল করে প্রশ্ন পড়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে উত্তর লিখবে, বুঝেছ?’ — এই আপ্তবাক্য আওড়ানোই বড় কাজ। তার পর পাক্কা তিনটে ঘণ্টা।

তখন চলছে মাধ্যমিক। নিজস্ব চিত্র

তখন চলছে মাধ্যমিক। নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস সৈয়দ ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৮
Share: Save:

রোজ বারবেলায় ওঁরা আড্ডা দেন। সাধ করে দেন তা নয়, আড্ডা দিতে ওঁরা বাধ্য।

কী আর করবেন?

রোজ দুপুর ১২টায় পরীক্ষা শুরু হয়। ছেলেমেয়েরা তার আগেই গুটি-গুটি পায়ে ঢুকে পড়ে স্কুলের ভিতরে। তার আগে ‘ভাল করে প্রশ্ন পড়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে উত্তর লিখবে, বুঝেছ?’ — এই আপ্তবাক্য আওড়ানোই বড় কাজ। তার পর পাক্কা তিনটে ঘণ্টা। তবে একঘেয়েমি মাত্র কয়েকটা মিনিটের। থিতু হতে যতক্ষণ লাগে। তার পরেই একটু-একটু করে খুলে যায় আড্ডার শতজল ঝর্না।

বহরমপুর জেএন অ্যাকাডেমির মাধ্যমিকের আসন পড়েছে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে। তার সামনে পুরসভার মার্কেট কমপ্লেক্সের একটি দোকানের সিঁড়িতে বসে পিয়ালি বসু পাশের বিথীকা মণ্ডলকে বলেন, ‘‘এই শোনো, তুমি কী করে ভেজ-কেক বানাও, একটু বলবে?’’ বকা হেসে বলেন, ‘‘তুমি যে চটজলদি বিরিয়ানি বানাও, সেটা আগে আমাকে শিখিয়ে দাও!’’ ১৯৯৮ সালে নবদ্বীপ আর সি বি সারস্বত মন্দির স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া ইস্তক অশোক সেনের প্রতিটি মাধ্যমিকের দিনগুলো কেটেছে ব্যস্ততায়। কিন্তু এ বার তিনি অন্য ভূমিকায়। তাঁর ছেলে এ বার পরীক্ষা দিচ্ছে। ফলে আর পাঁচটা অভিভাবকের মতো স্কুলের গেটের বাইরে খাড়া। সময় কাটছে গল্পগাছা করেই। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে একটি বাড়ির রোয়াকে জনা পাঁচেক অভিভাবকের মধ্যে বসে অশোক বলেন, “নিজের মাধ্যমিকের দিনগুলোর কথাও মনে পড়ছে। তখন তো আর বাবা-মায়েরা হলের বাইরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন না! তাঁদের সেই সময় বা ইচ্ছে কিছুই ছিল না।”

মাধ্যমিক-মায়েরা যাতে রোয়াকে জমিয়ে বসে তিন ঘণ্টা কলরব করতে না পারেন, তার জন্য বহরমপুরের মহারানি কাশীশ্বরী উচ্চ-বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে বিভিন্ন দোকানের মালিকেরা সামনের রোয়াকে জল ঢেলে রাখছেন। কিন্তু চৈত্রের আঁচে তা শুকোতে কতক্ষণ? আর মায়েরাও নাছোড়বান্দা। ঠিক পছন্দসই জায়গা বেছে বসে তাঁরা জুড়ে দিচ্ছেন গল্প।

কাশীশ্বরীতে আসন পড়েছে গোরাবাজার শিল্পমন্দির উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের। আড্ডা চলছে, সেই সঙ্গে চলছে চানাচুর, চিঁড়েভাজা, ঝালমুড়ি, চা-বিস্কুট, এমনকী কৌটো করে আনা আচারও। এই মায়েদেরই এক জন বেবি মণ্ডল বলেন, ‘‘স্বামী-সংসার, সিনেমা থেকে শুরু করে সামনে দিয়ে চলে যাওয়া বড় খোঁপার মহিলা, কথা কিছুই বাদ থাকছে না। এই করতে করতে কেটে যাচ্ছে সময়।’’

প্রাচীন মায়াপুরে জাতীয় বিদ্যালয়ে (বালিকা) আসন পড়েছে নবদ্বীপের একাধিক গার্লস স্কুলের। মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিয়েই ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে পড়ছেন মায়েরা। বাড়ির বারান্দা থেকে গাছতলা কিছুই ফাঁকা থাকছে না। অনেকে আবার বেছে নিচ্ছেন মঠ বা মন্দিরের নাটমন্দির। কেউ-কেউ আবার টুকটাক ঘুরেও নিচ্ছেন। যেমন তারণপুর থেকে মেয়ে নিয়ে আসছেন আরতি মণ্ডল। তিনি শুক্রবার গিয়েছিলেন প্রাচীন মায়াপুরে ষাট ফুট উঁচু মহাপ্রভু মূর্তি দেখতে। বলছেন, “এত কাছে যখন এসেছি, এক বার দেখেই যাই। আবার কবে আসা হয়, ঠিক নেই।”

ঘণ্টা পড়ার সময় হল। শাড়ি-ব্যাগ গোছগাছ করে নিয়ে মায়েরা তৈরি। সিগারেটে শেষ টান মেরে ছুড়ে দিয়ে বাবা এসে দাঁড়াচ্ছেন গেটের বাইরে। ভিতরে তিন ঘণ্টার যুদ্ধ শেষ। মুখে-মুখে ফিরছে সেই চেনা প্রশ্ন— ‘‘কী রে, কেমন হল? প্রশ্ন সোজা ছিল? সব লিখেছিস?’’

এ বার যে যার বাড়ির পথে।

আবার দেখা হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madhyamik Examination Guardians Students Chat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE