Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নিখুঁতি, মনোহরা এবং সিপাহি বিদ্রোহ

সে সময়ে শান্তিপুর গো-ভাগাড় মোড়ে ছিল ‘ইন্দ্র ময়রার’ বাড়ি। সে চিনির জন্য বিখ্যাত ওই কারিগরদের পদবী ছিল ইন্দ্র। তবে সে সময় ইন্দ্র ময়রার বাড়ির খ্যাতির অন্য একটি কারণও ছিল। পরিবারের এক রূপবতী মেয়ের নিখুঁত রূপের জন্য নাম হয়েছিল নিখুঁতি।

নিখুঁতি। —নিজস্ব চিত্র।

নিখুঁতি। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় নবদ্বীপ
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৪২
Share: Save:

সময়টা সিপাই বিদ্রোহের। খেজুর গুড় থেকে তৈরি ডেলা চিনির সে সময়ে শান্তিপুরে বিশেষ চল ছিল। সাহেবদেরও মুখে বেশ রুচত সেই মিষ্টি চিনির সেই ডেলা। জাহাজে সে চিনি বিলেতেও পাড়ি দিত। শান্তিপুরের ময়রাদের বেশ একটা সখ্য তৈরি হল সে চিনির দৌলতে।

সে সময়ে শান্তিপুর গো-ভাগাড় মোড়ে ছিল ‘ইন্দ্র ময়রার’ বাড়ি। সে চিনির জন্য বিখ্যাত ওই কারিগরদের পদবী ছিল ইন্দ্র। তবে সে সময় ইন্দ্র ময়রার বাড়ির খ্যাতির অন্য একটি কারণও ছিল। পরিবারের এক রূপবতী মেয়ের নিখুঁত রূপের জন্য নাম হয়েছিল নিখুঁতি।

তা সেই নিখুঁতিকে দোকানে বসিয়ে বাবা গিয়েছেন কোথাও। সুযোগ পেয়েই উনোনে চাপানো কড়াইয়ের তেলে মাখা ছানা লম্বা লম্বা করে পাকিয়ে ছেড়ে দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ছানা ভাজা হয়ে টকটকে লাল। ভয়ে তাড়াতাড়ি কড়াই থেকে তুলে গামলায় রাখা রসে মধ্যে ডুবিয়েই বাড়ি পালাল নিখুঁতি। দোকানে ফিরে মেয়ের কীর্তি দেখে বাবা চটে আগুন। তবে ব্যবসায়ী বাবা মেয়ের খেয়ালে তৈরি ওই মিষ্টি ফেলে না দিয়ে পরিচিতদের কাছে বিক্রি করলেন।

পর দিন সাত সকালে দোকানে হাজির আগের দিনের এক খরিদ্দার। সে জানতে চায় ওই মিষ্টির নাম কি। কানে খাটো বাবা প্রশ্ন বুঝতে ভুল করলেন। ভাবলেন জানতে চাইছে কে তৈরি করেছে। উত্তর দিলেন নিখুঁতি। বঙ্গবাসী পেয়ে গেল নতুন স্বাদের মিষ্টি। সময়টা ১৮৫৬’র আশপাশে।

বলছিলেন শান্তিপুরের স্থানীয় ইতিহাসের অনুসন্ধানী বাসিন্দা অমিতাভ মিত্র। তাঁর কথায় শান্তিপুরের নিখুঁতি লাটবেলাট থেকে স্যার আশুতোষের মতো মানুষের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। নিখুঁতি গড়ার কারিগর সেই ইন্দ্র পরিবারের দোকান বহুকাল উঠে গিয়েছে। কিন্তু শান্তিপুরের নিখুঁতি এখনও সমান জনপ্রিয়। কড়া করে ভেজে তারপর হালকা রসে ডুবিয়ে পরিবেশনের আগে উপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ানো নিখুঁতি তৈরি করে না, এমন মিষ্টির দোকান শান্তিপুরে নেই বললেই চলে। তবে কাশ্যপ পাড়ায় চাকফেরা গোস্বামী বাড়ির সংলগ্ন পশু ময়রার নিখুঁতি এখনও সেই ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে চলেছে।

দেড়শো বছরের পুরানো নিখুঁতির প্রায় সম সাময়িক মিষ্টান্ন পরিবারের আর এক সদস্য মনোহরার। বাংলা টপ্পার জনক রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবু শহরের বাবুগিরির গানে লিখেছেন “খাওয়াইব গণ্ডা গণ্ডা মনোহরা দেদো মণ্ডা। খেয়ে খেয়ে যাবে প্রাণটা বলবে বলিহারি যাই।” মুর্শিদাবাদের কান্দি, বেলডাঙ্গার মনোহরার সুখ্যাতি সেকালে কালাপানি পাড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ছিল সাহেবদের দেশেও। চাঁচি ক্ষীর আর ছানার সঙ্গে এলাচ, জায়ফল আর জয়িত্রীর মিশ্রণে তৈরি ‘পুর’ চিনির মোটা রসের আস্তরণে ঢেকে রাখার অননুকরণীয় শিল্পের নাম মনোহরা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রজগোপাল সাহা বেলডাঙ্গায় প্রথম মনোহরা তৈরি করলেন। বাংলার মিষ্টির ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন মনোহরার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনেক মতভেদ। সে যাই হোক দুধসাদা মনোহরার মাথায় বাহারি কিসমিসের অলঙ্করণে সত্যিই মনোহরা মুর্শিদাবাদের এই মিষ্টি। বেলডাঙার মনোহরা যদি অসিত সাহা, মদনগোপাল সাহারা বাঁচিয়ে রাখেন তবে কান্দির সুনাম রক্ষা করছেন শিবশক্তি দে বা রুদ্রদেব দত্তেরা। সে ট্রাডিশন এখনও চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sweet Nikhuti নিখুঁতি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE