Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অভাব ঠেলে আঁধার হাতড়ে এল সাফল্য

বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মুর্শিদাবাদের সুতি, সেখানেই  পদ্মাপাড়ের ফতুল্লাপুর গ্রামে বেবিদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই চোখে দেখে না সে। তা হলে হবে কী, লেখাপড়ায় অদম্য ইচ্ছে তার। বাড়ির লোকেরাই তাকে পাঁজকোলা করে পৌঁছে দিত স্কুলে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেবি দাস। নিজস্ব চিত্র

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেবি দাস। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৮ ০১:৩২
Share: Save:

একটা আটপৌরে টেপ-রেকর্ডার আর দৃষ্টিহারা একটি মেয়ে— পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থেকেছে আঠারোটা মাস। শুক্রবার ফল বেরোলে দেখা গিয়েছে, হাতড়ে হাতড়ে উচ্চমাধ্যমিকের একটা শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে তারা। যা দেখে আপ্লুত মেয়েটির স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিস তিওয়ারি বলছেন, ‘‘ওই একটা ছাপোষা টেপ রেকর্ডার সম্বল করে মেয়েটা যে এত দূর যেতে পারবে তা আমি ভাবতেই পারিনি।’’

বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মুর্শিদাবাদের সুতি, সেখানেই পদ্মাপাড়ের ফতুল্লাপুর গ্রামে বেবিদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই চোখে দেখে না সে। তা হলে হবে কী, লেখাপড়ায় অদম্য ইচ্ছে তার। বাড়ির লোকেরাই তাকে পাঁজকোলা করে পৌঁছে দিত স্কুলে। ব্রেইল থেকে অনেক দূরে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে স্রেফ মাস্টার মশাইদের পড়া শুনেই মুখস্থ করে মাধ্যমিক পর্যন্ত তার পড়াশোনা।

কিন্তু কলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরে পড়াশোনাটাই থমকে যেতে বসেছিল তার। আর কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সে। সেই সময়ে আশিসবাবু স্কুল থেকেই ওই টেপ রেকর্ডারের ব্যবস্থা করে দেন। আর সেখানেই স্কুলের পড়া রেকর্ড করে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে ৩৭০ পেয়ে প্রথম বিভাগ পাশ করেছে সে। বেবি বলছে, ‘‘শুনে আর মুখস্থ করতে পারছিলাম না। পিছিয়ে পড়ছিলাম। রেকর্ডারটা হাতে পেয়ে যেন স্বর্গ পেলাম। ক্লাসে শিক্ষকদের পড়ানো রেকর্ড করে বাড়ি ফিরে সেই অডিয়ো চালিয়ে বার বার শুনে পড়া মুখস্থ করেছি। কোচিংয়েও ভরসা সেই অডিয়োই। আর এই ভাবেই এবারে রাইটার নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গেলাম।’’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেবি দাস । নিজস্ব চিত্র

বাবা তেনুলাল দাস দিনমজুর। দাদাও দিনমজুর। মা ও পড়ুয়া বোন কাজের ফাঁকে বিড়ি বাঁধেন। অভাবের সংসারে তবু মেয়েকে বোঝা মনে করেননি তেনুলাল। বোন দীপা বলছে, ‘‘দিদিকে প্রথমে স্কুল নিতে চায়নি। দু’বছর পরে তাই ভর্তি হয়েছিল দিদি।’’ তার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মা আরতি বলছেন, “গ্রামের পাশেই স্কুল। বোনই ওর ছায়া সঙ্গী। সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে আসা যাওয়া। মাধ্যমিক পর্যন্ত বইপত্র, খাতা যখন যা প্রয়োজন পড়েছে সাহায্য করেছেন শিক্ষকেরা । এমনকি স্কুলে ভর্তি বা পরীক্ষার ফি, কোচিং সব কিছুতেই ছাড় পেয়েছে। স্কুলের কাছে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ।’’

নদিয়ার তেহট্ট এলাকায় এমনই এক লড়াইয়ের গল্প লুকিয়ে রয়েছে তেহট্ট এলাকায়। সেখানে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে রূপসিনা খাতুনও চিনিয়ে দিয়েছে তার নিহিত ক্ষমতা।

বছর দুই আগে, মাধ্যমিক পাশ করার পরেই অভাব তার পড়াশোনা প্রায় থমকে দিয়েছিল। সরকারি সাহায্য পেয়ে এ বার হাঁসপুকুরিয়া বিদ্যাপীঠের রূপসিনা পেয়েছে ৪৬২। বাংলায় ৮৭, সংস্কৃতে ৯৭, ইতিহাসে ৮৮, দর্শনে ৯৭, ইংরেজিতে ৯০ ও ভূগোলে ৯১ তার প্রাপ্ত নম্বর। বাবা হাফিজউদ্দিন মণ্ডল দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। পাটকাঠির একমাত্র ঘরে স্ত্রী ফুলমনি বিবি, ছেলে নবম শ্রেণীর ছাত্র সাহাদুল ও মেয়ে রূপসিনাকে নিয়ে তাঁদের দিনযাপন।

স্কুলের শিক্ষক বরুণ সিংহ বলেন, “মাধ্যমিকের পরেই রূপসিনার পরিবার জানায়, আর টানতে পারছেন না তাঁরা। কাগজে এই লড়াইয়ের কথা পড়ে সাহায্য এসেছে দু’হাত ভরে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Higher Secondary Results 2018 Education Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE