Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাবা বলেছিল, ‘পরের বার আরও বড় করে পুজো করব, দেখিস!’

ও পাশে শো-কেসের উপরে রাখা দু’টি ছবি। একটিতে সৌম্যর বাবা একা, আর একটি সোমার সঙ্গে। সে দিকে এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নেন সোমা। বলেন, ‘‘সব কিছু ভুলতে চাই, জানেন! ছেলেকে আঁকড়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। পারছি কই? অনেক কথাই যে ভুলতে পারছি না!’’

শান্তনুর স্ত্রী-পুত্র। নিজস্ব চিত্র

শান্তনুর স্ত্রী-পুত্র। নিজস্ব চিত্র

সৌমিত্র সিকদার
চাকদহ শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০২:১১
Share: Save:

সবই আছে আগের মতো।

শরতের পাল্টে যাওয়া রোদ, রাত আর ভোরে শিরশিরে হাওয়া, মাঠে ঢলোঢলো কাশ, কাছে-দূরে ভেসে থাকা ঢাকের বোল।

শুধু বাবা নেই।

আগের বার তো পাড়ার মণ্ডপ জুড়ে খালি বাবাকেই ছুটোছুটি করতে দেখেছিল সে। কত্ত কাজ! খুব মেতে ছিল। বলেছিল, ‘পরের বার আরও বড় করে পুজো করব, দেখিস!’

পরে বার... পরের বার কবে?

ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা টুলে মাথা নিচু করে বসেছিল বছর দশেকের সৌম্য। গত কয়েক দিন ধরে তার মন ভাল নেই। যত পাকা গমের মতো হয়ে উঠেছে রোদ, পাড়ায়-পাড়ায় বাজনা বেজে উঠেছে, তত যেন গুটিয়ে গিয়েছে সে।

ব্যস্ততার মধ্যেও বাবা তো খোঁজ রাখত, সপ্তমীর সকালে সৌম্য কোন জামাটা পরবে যেন? আর নবমীর সন্ধেয়? এ বারও তার পাঁচটা নতুন জামা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নেবে কে?

মা আছে অবিশ্যি! কিন্তু মায়েরও তো চোখের কোল শূন্য। হাসি টেনে রেখেছেন মুখে, কিন্তু মায়েরও মন ভাল নেই, এক্কেবারে ভাল নেই— সৌম্য জানে। মা কি এ বার নতুন শাড়ি পরবে না?

সে ঘরে খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে সৌম্যর মা সোমা। নালিশের সুরেই বলেন, ‘‘দেখুন না, গত কয়েক দিন ধরেই ছেলেটা মনমরা। কোনও কিছুই যেন ওর ভাল লাগছে না!”

ও পাশে শো-কেসের উপরে রাখা দু’টি ছবি। একটিতে সৌম্যর বাবা একা, আর একটি সোমার সঙ্গে। সে দিকে এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নেন সোমা। বলেন, ‘‘সব কিছু ভুলতে চাই, জানেন! ছেলেকে আঁকড়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। পারছি কই? অনেক কথাই যে ভুলতে পারছি না!’’

ভোলা কি সহজ? চোখের সামনে গুলি করে মারার দৃশ্য কি চাইলেই মাথা থেকে মুছে ফেলা যায়?

একটা বছরও তো কাটেনি! এই তো গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে জলসা চলছিল চাকদহ শহরের কে বি এম এলাকায়। পাড়ার মঞ্চ থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন মোবাইল মিস্ত্রি শান্তনু শীল। সৌম্যর বাবা। একটা গান নিয়ে কয়েক জনের সঙ্গে সামান্য তর্কাতর্কি, আর তার পরেই চলল গুলি। মঞ্চেই ছিটকে পড়লেন শান্তনু।

সামনেই দর্শকের আসনে তখন বসে সোমা, সঙ্গে সৌম্যও। সকলে শান্তনুকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। সোমার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সকলেই বুঝছিলেন, কী হয়েছে। ডাক্তার দেখে বললেন, শান্তনু আর নেই। অন্ধকারটা ভারী পর্দার মতো নেমে এল মা-ছেলের চোখের উপরে।

এর পরে সংসারটার মাথার উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। ছোট্ট ছেলের হাত ধরে আদালতে যাওয়া, গোপন জবানবন্দি দেওয়া। মুখ বুজে সব করে গিয়েছেন সোমা। চেনা খুনি, অচেনা হয়ে ওঠা নেতা— সয়ে যেতে হয়েছে সব। চোয়াল শক্ত করে শুধু ভেবেছেন, যে ভাবে ছেলেটাকে মানুষ করতেই হবে।

সময়ের ডানায় অন্তহীন গতি। শীত কেটে গরম পড়ে, ছলছলে বর্ষা পেরিয়ে পুজোর আশ্বিন।

সোমা বলেন, “গত বছর পাড়ার পুজো নিয়ে কী যে হইচই করেছিল লোকটা। এ ভাবে চলে যাবে বলেই হয়ত এত হইচই!’’ এ বারও পাড়ায় পুজো হচ্ছে। তবে সে দিকে তেমন যাচ্ছেন না মা ছেলে। ‘‘কেউ সে ভাবে ডাকেওনি আমাদের’’— বলেই যেন সোমার মনে পড়ে যায়, ছেলেটা সারা পুজো ঘরে বসে থাকবে?

‘‘ভাবছি, এ বার ছেলেকে নিয়ে খানিক দূরে ছাত্রমিলনী মাঠের মণ্ডপে গিয়ে বসে থাকব”— সোমা যেন নিজেকেই বলেন খুব নিচু স্বরে। যেন নিজেকেই বলেন, ‘‘বলেছিল, পরে‌র বার পাড়ায় আরও ভাল করে, আরও বড় করে পুজো করবে...।’’

পরে বার... পরের বার কবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Case TMC Chakdaha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE