Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শীতের আনাজের দর নেই

ভোর থাকতেই বিছানা ছেড়ে মাঠে গিয়েছিলেন প্রবীর ঘোষ। খেত থেকে পঞ্চাশ পিস ফুলকপি আর কেজি পাঁচেক শিম নিয়ে তিনি আসেন শিমুরালি বাজারে।

সৌমিত্র সিকদার
রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

ভোর থাকতেই বিছানা ছেড়ে মাঠে গিয়েছিলেন প্রবীর ঘোষ। খেত থেকে পঞ্চাশ পিস ফুলকপি আর কেজি পাঁচেক শিম নিয়ে তিনি আসেন শিমুরালি বাজারে। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টা বেজে গেলেও ভ্যানরিকশায় থাকা অর্ধেক কপি বিক্রি করতে পারেননি। কেউ পালং শাক, কেউ বেগুন, কেউ বা মুলো নিয়ে তাঁর পাশে বসেছিলেন। তাঁদের মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ।

চাকদহের শিমুরালি পঞ্চায়েতের তেলিপুকুরের বাসিন্দা প্রবীর বলেন, “এ বার অবস্থা খুব খারাপ। আনাজ বিক্রি করতে পারছি না। শিমগুলো এই বাজারে পাইকারি বিক্রি করেছি। কপি নিয়ে বসে রয়েছি। মনে হচ্ছে, সব বিক্রি করতে পারব না।”

মূলত দু’ভাবে আনাজ বিক্রি করেন চাষিরা— ১) নিজেরা সরাসরি বাজার-হাটে গিয়ে খুচরো দরে। এতে দর বেশি পান। ২) মাঠ থেকে ফড়ের কাছে বা পাইকারি বাজারে গিয়ে। বহু সময়েই ফড়েরা যথেষ্ট দাম দিতে চান না বলে অভিযোগ। পাইকারি দরে বেচলে চাষির লাভ স্বাভাবিক ভাবেই কমে যায়।প্রবীরের পাশ থেকে আনসার মণ্ডল বলেন, “পাইকারি বিক্রি করলে ঝামেলা কম। কিন্তু তাতে লাভ থাকে না। সেই কারণে অল্প করে পালং শাক সরাসরি বাজারে নিয়ে আসছি।” দু’জনেই বলছেন, এই ভাবে যা-ও দু’চার টাকা চোখে দেখা যাচ্ছে, মদনপুর আনাজের হাটে গেলে তা-ও পাবেন না।”

চান্দুরিয়া ১ পঞ্চায়েতের মলিচাগড় গ্রামে মাঠের ধারে মলিন মুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাত্তার মণ্ডল। তিনি বলেন, “এ বার বেগুন, মুলো, পালং শাক চাষ করেছি। কিন্তু কোনও কিছুর দাম নেই। অর্ধেক দামেও বিক্রি হচ্ছে না। মাঠ থেকে আনাজ তুলতে এক জন লোক লাগে। তাকে টাকা দিয়ে নিজের বলতে আর কিছুই থাকবে না। ভাবছি কী করব!” একই কথা শুনিয়ে সরাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা জহিরুল সর্দার বলেন, “আনাজের কথা ভাবলেই জ্বর এসে যাচ্ছে। কেউ বলতে পারবে না, এ বার চাষ করে লাভবান হয়েছে।”

কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?

চাষিরা জানান, এ বার আবহাওয়া ভাল ছিল। অসময়ে ঝড়বৃষ্টি হয়নি। ফসলের ক্ষতি হয়নি। সকলের মাঠেই উৎপাদন ভাল হয়েছে। সবাই বাজারে আনাজ নিয়ে আসছে। অতিফলনের জেরে বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হয়ে গিয়েছে। এ দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় শ্যালো পাম্প চালিয়ে জল দিতে হয়েছে। তাতে খরচ বেশি হয়েছে। এখন চাষিরা খরচ তুলতে পারছেন না।

তা বলে খুচরো বাজারে যে দাম খুব কমে গিয়েছে, মধ্যবিত্ত মনের আনন্দে থলি ভরে বাজার করছে, তেমনটা নয়। বরং পাইকার বা ফড়েরা লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে বলে চাষিদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ। সরাটির জহিরুলের আক্ষেপ, ‘‘আমরা দাম পাচ্ছি না। কিন্তু, বাজারে গেলে সস্তা পাচ্ছি না, ভাল দামে আনাজ কিনতে হচ্ছে। অধিকাংশ জায়গাতেই ফড়েরা ভাগ বসাচ্ছে।”

ফড়ে বা পাইকারেরা কিন্তু তা মানতে রাজি নন। মদনপুর, চাকদহ হাট অথবা বিভিন্ন মাঠ থেকে সরাসরি আনাজ কিনে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির গৌরাঙ্গ হালদার। তিনি বলেন, “বিশ বছরের বেশি সময় ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। অনেকেই ভাবেন, আমরা বুঝি অনেক লাভ করি। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। এখান থেকে বিভিন্ন বাজারে আনাজ নিয়ে গিয়ে খুব বেশি লাভ হয় না।” তাঁর মতে, বাজারে এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আনাজ চলে আসাতেই দাম কমেছে।

নদিয়া জেলা কৃষি আধিকারিক রঞ্জন রায়চৌধুরীও বলেন, “এক সঙ্গে সব ফসল উঠে যাওয়াতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। শীতে চাষিরা বিভিন্ন পর্যায়ে চাষ করেন। এ বার তাপমাত্রা অন্য বারের চেয়ে বেশি হওয়ায় উৎপাদন বেড়েছে। তাই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’’ তবে তাঁর মতে, এ নিয়ে হাহাকারের কোনও কারণ নেই। তাপমাত্রা একটু কমলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Winter Vegetables Farmer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE