রানাঘাট কেন্দ্রের গেরুয়া সুনামিতে সবুজ দ্বীপ হয়ে জেগে রয়েছে শুধু নবদ্বীপ। কিন্তু সত্যিই কি মন্দিরনগরী নন্দ সাহার দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে চলেছে আজও?
ভোটের ফল বলছে, আদৌ নয়। নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রের শহর ও গ্রামীণ এলাকা মিলিয়ে মাত্র ৪০৬৪ ভোটে এগিয়ে তৃণমূল। মুসলিম-প্রধান গ্রামাঞ্চল এখনও তৃণমূলকে আঁকড়ে থাকলেও শহর তাদের ত্যাজ্য করেছে। নবদ্বীপ শহরের ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতেই এগিয়ে বিজেপি। তার মধ্যে রয়েছে পুরপ্রধানের ওয়ার্ডও রয়েছে। সব মিলিয়ে শহরে বিজেপি পেয়েছে ৪০২১২ ভোট, তৃণমূল ৩১২৬১। এই শহরে এই প্রথম বিজেপি পিছনে ফেলে দিল তৃণমূলকে। নবদ্বীপে যে ওয়ার্ডগুলি তৃণমূলকে এগিয়ে রেখেছে সেগুলি হল ৩, ৮, ৯, ১০, ১৩ এবং ১৫। এর মধ্যে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র ৩৩ ভোটে এবং ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র ৭৭ ভোটে এগিয়ে আছে তারা। সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে এগিয়ে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে, ৩৩৫ ভোটে।
উল্টো দিকে, বিজেপি ২০ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ লিড পেয়েছে, তৃণমূলের চেয়ে ১৪২২ ভোটে এগিয়ে আছে তারা। পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহার নিজের ৪ নম্বর ওয়ার্ডেও তারা ২৭৯ ভোটে এগিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭২৭ ভোটে, ৫ নম্বরে ৯২০ ভোটে, ৬ নম্বরে ৮৩০ ভোটে, ১৬ নম্বরে ৮৩৬ ভোটে, ২৪ নম্বরে ৭৭১ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তারা।
তবে নবদ্বীপের উপ-পুরপ্রধান শচীন্দ্র বসাকের ওয়ার্ডে এগিয়ে আছে তৃণমূল। এই ওয়ার্ডটি নবদ্বীপ শহরের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলা-কেন্দ্রিক। এ ছাড়া বাকি যে পাঁচটি ওয়ার্ডে তৃণমূল এগিয়ে আছে সেগুলি সবই শহরের পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চল-ভিত্তিক। কিন্তু বাকি প্রান্তিক অঞ্চল যেমন উত্তরে প্রাচীনমায়াপুর, দক্ষিণে তেঘরিপাড়া, কলাবাগান অথবা পশ্চিম দিকে মালঞ্চপাড়া, বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট সর্বত্রই বহু ভোটে এগিয়ে আছে বিজেপি।
নবদ্বীপ পুর এলাকার এই ফলাফলে হিন্দু ভোট বিভাজনের ছায়া যেমন স্পষ্ট, শাসকদলের এক শ্রেণির নেতাকর্মীর কাজকর্ম এবং পুরসভার নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শহরের মানুষের বিপুল ক্ষোভের ছায়াও স্পষ্ট। কেননা শুধু ধর্মীয় বিভাজন হলে ফল আরও খারাপ হতে পারত। পুরবাসীর ক্ষোভের তালিকায় রয়েছে গঙ্গা থেকে পরিস্রুত পানীয় জলের সংযোগের অস্বাভাবিক চড়া দর, ট্রেড লাইসেন্সের মতো নানা ক্ষেত্রে ফি কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রায় কুড়ি বছর ধরে এই পুরসভায় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াও জোরালো হয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সর্বোপরি গোটা রাজ্যের ধারা মেনে নবদ্বীপেও বামেদের ভোট গিয়েছে বিজেপির দিকে। যার নিট ফল প্রায় দু দশক পরে নবদ্বীপ শহরে তৃণমূলের মুখ থুবড়ে পড়া। নবদ্বীপের বিজেপি নেতা তথা প্রদেশ পরিষদ সদস্য জীবন সেনের মতে, “তৃণমূলের সীমাহীন দুর্নীতির এবং ঔদ্ধত্যের জবাব এই ফল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে এখন ওঁরা মানুষকে আর মানুষ জ্ঞান করেন না। এ বার সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে মানুষ। এত দিন কোনও বিকল্প ছিল না, এবার বিজেপি বিকল্প হয়ে উঠেছে।”
অর্থাৎ এই ফল অনেকটাই পুরসভা ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে জনমত?
পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা তা মানতে রাজি নন। তিনি বরং এই ফলকে দেশব্যাপী মোদী-ঝড়ের প্রভাব বলেই মনে করছেন। তাঁর দাবি, “এটা একটা দমকা হাওয়া। রাজনীতিতে এর কোনও স্থায়ী প্রভাব পড়বে না। সেই সঙ্গে কাজ করেছে ধর্মীয় ভাবনা, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। না হলে যে মায়াপুর-বামুনপুকুর ১ নম্বর পঞ্চায়েত কোনও দিন তৃণমূলকে জেতায় না, সংখ্যালঘু অঞ্চল বলেই সেখানে এ বার কয়েক হাজার ভোটে আমরা লিড করেছি। এমন উদাহরণ আরও আছে। এই ফল তারই পরিণতি। তবে এই প্রবণতা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy