Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গয়েশপুরে মুকুলের ভূমিকা নিয়ে জল্পনা

ভোটের আগেই তিন পুরসভা দখলে এলেও শাসক দলের অন্দরে জোর জল্পনা নদিয়ার গয়েশপুর নিয়েই। কারণ, রাজ্যের যে সব এলাকা অধুনা কোণঠাসা মুকুল রায়ের খাসতালুক বলে পরিচিত, গয়েশপুর তার অন্যতম। মুকুলের দুর্দিনেও কী ভাবে ওই পুরসভা অনায়াসে দখলে এল, জল্পনা তা নিয়েই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

ভোটের আগেই তিন পুরসভা দখলে এলেও শাসক দলের অন্দরে জোর জল্পনা নদিয়ার গয়েশপুর নিয়েই। কারণ, রাজ্যের যে সব এলাকা অধুনা কোণঠাসা মুকুল রায়ের খাসতালুক বলে পরিচিত, গয়েশপুর তার অন্যতম। মুকুলের দুর্দিনেও কী ভাবে ওই পুরসভা অনায়াসে দখলে এল, জল্পনা তা নিয়েই।

গয়েশপুর পুরসভার মোট আসন ১৮। তার মধ্যে ১৭টিতে বিজেপি, ১৫টিতে বামেরা, ১১টিতে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল। দু’টি ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থীও ছিলেন। তৃণমূল লড়ছিল সব ক’টি আসনেই। শনিবার, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে এক জন নির্দল ছাড়া বাকি সব বিরোধী প্রার্থীই ভোটের লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে ১৭টি আসনে জিতে গয়েশপুরে তৃণমূল নিরঙ্কুশ।

এই ঘটনায় মুকুলের ভূমিকা কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। মুকুল-ঘনিষ্ঠ শিবিরের দাবি, বিরোধীদের ‘আত্মসমর্পণের’ পিছনে তাদেরই হাত রয়েছে। এ কাজে নেমেছিল মুকুল ও তাঁর ছেলে, বীজপুরের বিধায়ক শুভ্রাংশুর বাহিনী। এবং সেটা করা হয়েছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই। অর্থাৎ, মুকুল যদি তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা দল গড়েন, তা হলে গয়েশপুর তাঁর হাতে থাকবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া তৃণমূল প্রার্থীদের অধিকাংশই মুকুল রায়ের অনুগত বলে তাঁর শিবিরের দাবি। এমনকী, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে যে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী এ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি, সেই নিখিল গায়েনও মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। এই পরিস্থিতিতে মুকুল শিবিরের এক নেতার মন্তব্য, “মুকুলদা আসলে ভবিষ্যতের জন্য ভল্টে সব অলঙ্কার গচ্ছিত রাখছেন।”

মুকুল নিজে অবশ্য গয়েশপুরে তাঁর বা শুভ্রাংশুর কোনও ভূমিকার কথা স্বীকার করেননি। দিল্লি থেকে ফোনে এ দিন তিনি বলেন, “আমি খেলার বাইরে। ফেন্সিং থেকে অনেক দূরে। তা ছাড়া, গয়েশপুর আমার জায়গা নয়। আমার জায়গা কাঁচরাপাড়া।” কিন্তু বিরোধীরা তো শুভ্রাংশুর বাহিনীর বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছে? মুকুলের জবাব, “আমার কোনও অনুগামী বা আমার ছেলে কেউ এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। আমি ভাল করে খোঁজ নিয়েই বলছি।”

গয়েশপুরে মুকুলের ভূমিকার কথা অবশ্য সরকারি ভাবে মানছে না তৃণমূলও। দলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, “এত দিন গয়েশপুর, কল্যাণী সবই মুকুল দেখত। কিন্তু দলনেত্রী জয়ের মুখ দেখেননি। মুকুলকে সরিয়ে অন্য নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার পরেই তো সাফল্য এল।” এ বার পুরভোটে নদিয়া জেলার দায়িত্ব মমতা দিয়েছেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। তিনি এ দিন বলেন, “গয়েশপুরে এত দিন সিপিএমের জমিদারি ছিল। মানুষ সেই জামিদারির দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে। বিরোধীরা কোনও রকমে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। হার নিশ্চিত বুঝতে পেরেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে।”

কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে এত সহজ ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। শাসক দলে ক্ষমতার সমীকরণে পালাবদলের পরে পুরভোটে টিকিট পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন মুকুল-ঘনিষ্ঠরা। কিন্তু প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের থেকে তাঁদের দূরত্ব বাড়াতে এবং বিদ্রোহ এড়াতে তাঁদের বেশির ভাগকেই প্রার্থী করা হয়। তার পরেও ভবিষ্যতে মুকুল যদি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, তখন এই সব অনুগামীরা কোন দিকে ঝুঁকবেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন তৃণমূল নেতৃত্ব। বিনাযুদ্ধে গয়েশপুর জয় সন্তুষ্টি আনার বদলে তাঁদের কপালের ভাঁজ বাড়িয়েছে বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর।

রাজ্যে পরিবর্তনের পর কাউন্সিলরদের দলত্যাগের জেরে বহু পুরসভাই বিরোধীদের হাতছাড়া হয়েছে। মূলত মুকুল রায়ের নেতৃত্বেই গোটা রাজ্যে একের পর এক পুরসভা দখল করেছিল তৃণমূল। কিন্তু গয়েশপুরে তারা দাঁত ফোটাতে পারেনি। তা সত্ত্বেও ভিতরে ভিতরে যে জমি আলগা হয়েছিল, সেটা বোঝা যায় পুরভোট ঘোষণা হওয়ার পরেই। তিনটি ওয়ার্ডে প্রার্থীর নামই ঘোষণা করতে পারেনি বামফ্রন্ট। আর শনিবার তো শেষ পর্যন্ত সব প্রার্থী প্রত্যাহারই করে নিতে হল। বামফ্রন্টের তরফে এ জন্য শাসক দলের সন্ত্রাসকে দায়ী করা হলেও বামেদের সাংগঠনিক জোর নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জবাবে বিদায়ী চেয়ারম্যান গোপাল চক্রবর্তী বলেন, “২০১১ সাল থেকে বর্তমান শাসক দলের সন্ত্রাস চলছে। তার মধ্যেও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে যুঝছিলাম। কিন্তু বনগাঁ লোকসভা আসনে সাম্প্রতিক উপ-নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। অনেকেই তাতে ঘাবড়ে যান। সে কারণে প্রার্থী দাঁড় করানো যায়নি।”

শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে শুক্রবার রাতেই কল্যাণী থানার সামনে আলাদা আলাদা অবস্থান-বিক্ষোভ করে বামফ্রন্ট এবং বিজেপি। পুলিশের কাছে স্মারকলিপিও জমা দেয় তারা। “আমাদের ছয় মহিলা প্রার্থীকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। বাকি ১১ জন বা তাঁদের পরিবারের লোকেদেরও ফোনে ভয় দেখানো হয়েছে।” তাঁদের এক প্রার্থীর শিশু সন্তানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অভিযোগ করেছেন। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, “মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগেই মনোনয়ন প্রত্যাহার হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোনও কারণ হচ্ছে? আসলে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। ফলে ভোট মোটেই সুষ্ঠু ও অবাধ হচ্ছে না। পঞ্চায়েতেও এ জিনিস আমরা দেখছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছেন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছেন।

বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশের কাছে একাধিকবার অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কল্যাণী থানার অবশ্য দাবি, অভিযোগ পাওয়ামাত্রই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে। কিন্তু কার্যত সন্ত্রাসের কোনও প্রমাণ মেলেনি। মহকুমাশাসক (কল্যাণী) স্বপনকুমার কুণ্ডুও দাবি করেছেন, “সন্ত্রাসের কোনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতাম।”

সন্ত্রাস চালানো বা হুমকি দিয়ে বিরোধীদের প্রার্থী প্রত্যাহার করানোর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “যদি সন্ত্রাস হতো, যদি ভয় দেখানো হতো, তা হলে কোথাও না কোথাও অভিযোগ দায়ের হতো। কোথাও এ ধরনের অভিযোগ দায়ের হয়নি।” মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তৃণমূল সভাপতি (কল্যাণী শহর) তথা গয়েশপুরের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক অরূপ মুখোপাধ্যায়ের সংযোজন, “গত লোকসভা উপ-নির্বাচনে গয়েশপুরে ১৪টি ওয়ার্ডে আমরা অনেক ভোটে এগিয়েছিলাম। পুরভোটে হার অনিবার্য বুঝেই বিরোধীরা রণে ভঙ্গ দিলেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE