Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Goldsmith

বাবার কষ্টটা ছোটতেই বুঝেছিল দেবু

বাবার কষ্টটা ওই বয়সেই বুঝতে পারত দেবু। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হত তার।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ছন্দক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ০১:২৬
Share: Save:

রাস্তাটা তার বহু দিনের চেনা। অন্য দিন সকালের এই সময়টা গাড়ি-ঘোড়া আর মানুষের ভিড়ে গমগম করে বড়ুয়া মোড়। অথচ, আজ সকালে সেই জায়গাই একেবারে অচেনা ঠেকল দেবুর। সকাল ১০টা বাজতে চলল, অথচ, কাকপক্ষীর দেখা নেই! সকাল থেকে তার টোটোয় একজন প্যাসেঞ্জারও ওঠেনি। সাধারণ ধর্মঘটের দিনটা কি তবে এমনই ‘শুখা’ যাবে তার। চিন্তায় ডুবে যায় সে। বেলডাঙার মহুলা গ্রামে বাড়ি দেবুর। লেখাপড়া ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। ছোট থেকে সংসারে দারিদ্র আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল। দেবু, তার দু’টো পিঠোপিঠি বোন, বাবা-মা— পাঁচজনের সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে অল্প বয়সেই বুড়িয়ে গিয়েছিল তাদের বাবা নিরাপদ। ছোট থেকে দেবু দেখেছে, বাবা অন্যের জমিতে মুনিশ খাটছে। বছরের পাঁচ-ছ’মাস নিরাপদ মুনিশ খাটত। বাকি ছ’মাস এর-ওর বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার, টুকিটাকি কাজ করে কাটত তার। চেষ্টায় খামতি ছিল না। কিন্তু তার একার রোজগারে পাঁচজনের সংসারে সচ্ছলতা আসেনি কোনও দিনও।

বাবার কষ্টটা ওই বয়সেই বুঝতে পারত দেবু। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হত তার। মনে হত, ‘‘আমি ইনকাম না করা অবধি বাবার কষ্ট কমবে না।’’ দেবুর মনে হত, লেখাপড়া শিখে কিস্যু হবে না। তার চেয়ে রোজগারের চেষ্টা করা ভাল। ক্লাস সিক্সে ফেল করার পর আর স্কুলমুখো হয়নি সে। তার পাড়ার মন্টুদা মুম্বইয়ে সোনার কাজ করত। স্কুল ছাড়ার পর সেই ‘মন্টুদা’র হাত ধরে দেবুও মুম্বইয়ে চলে গেল। কয়েক বছর সেখানে কাজ শিখে সে গ্রামে ফিরে আসে। তারপর বাড়িতেই সোনার গয়না বানাত। মূলত, নাকছাবিই বানাত সে। তবে ভাল অর্ডার জুটলে অন্য গয়নাও বানাত। দেবুর হাতের কাজ এতটাই ভাল ছিল যে, দ্রুত গয়নাশিল্পী হিসেবে এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।

গত কয়েক বছরে তার হাত ধরে সংসারে একটু একটু করে সচ্ছলতা এসেছে। আগে তাদের দরমার বাড়ি ছিল। এখন সেটা পাকা হয়েছে। একা হাতে সে দুই বোনের বিয়ে দিয়েছে। নিজেও জীবনে থিতু। এখন আর বাবাকে কাজে যেতে দেয় না সে।

তবে গত এক বছর ধরে নাকছাবির বিক্রিবাটা এক্কেবারে কমে গিয়েছে। আগে বিয়ের মরসুমে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবারা তার বাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত। অথচ, এ বার! পুরো অঘ্রাণ মাসটা মোটে তিনটে নাকছাবি বিক্রি হয়েছে তার। রোজগারটা হুট করে এতটা কমে যাওয়া তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। উপায়ান্তর না দেখে জমানো পুঁজি ভেঙেই মাসখানেক আগে একটা পুরনো টোটো কিনেছে সে। এখন রোজ সকাল হলে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। বেলা পর্যন্ত টোটো নিয়ে চরকি পাক। দুপুরে একবার

বাড়িতে খেতে যাওয়া। নাকছাবির ছুটকোছাটকা অর্ডার থাকলে সেই কাজ করা। তারপর বিকেল হলে ফের বেরিয়ে পড়া টোটোয়। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। রাস্তায় টোটো ছেয়ে গিয়েছে। ফলে রোজগার প্রায় কিছুই হয় না। এক সময় এলাকায় দক্ষ গয়নাশিল্পী হিসেবে লোকে তাকে মান্যি করত। আর্থিক অবস্থা পড়তে শুরু করার পর তাদের অনেকের চাউনি বদলে যেতে লাগল। দেবু বেশ বোঝে তা। রাস্তায় টোটো নিয়ে তাকে ঘুরতে দেখে অনেকে এখন তার দিকে ‘করুণার’ চোখে তাকায়। বুকের ভেতরটা হঠাৎই একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

মাঝেমধ্যে দেবু অনেক কথা ভাবে। এই যে রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার ‘স্টার্টআপ বিজনেস’, ‘সেজ়’ তৈরি— নানান সব গালভারী কথা বলে, বেলডাঙার এক সময়ের বিখ্যাত নাকছাবি শিল্প এভাবে মরতে বসেছে। কই তাকে বাঁচানোর কথা তো কারও মনে হয় না। মনে মনে নেতাদের গাল পাড়ে দেবু।

নাহ, এভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। জাতীয় সড়ক ধরে টোটো নিয়ে এগিয়ে যায় সে। যদি প্যাসেঞ্জারের দেখা মেলে। এমন সময় তার কানে আসে— ‘হোই টোটো।’’ তারই বয়সী এক জন হাত নাড়ছে। দেবু টোটো দাঁড় করায়। ‘‘মহেশপুর যাব, কত নিবি,’’।

‘তুইতোকারিটা’ এ ক’দিনে সয়ে গিয়েছে তার। ওই সম্বোধন সে গায়ে মাখে না। দেবু বলে, ‘যা হোক একটা দেবেন’’।

টোটো চলতে শুরু করে। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। আস্তে আস্তে দূরে মিশে যায় রংচটা টোটোটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Goldsmith Beldanga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE