বসন্ত উৎসব। নাদুরিয়া ও বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
পিচকারিতে রঙগোলা জল ধরে যখন দোকানি ‘বাঁশি’ পিচকারি পরখ করে দেখাচ্ছিলেন চোখ গোল গোল করে তাই দেখছিল মতি। বিস্ময়ে মুখটা হাঁ। নিজের চোখকেও যে বিশ্বাস হয় না! এ পিচকারি একাধারে বাজে আবার রঙগোলা জলও ছেটায়! বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে ডান হাতে মায়ের তর্জনী চেপে ধরে।
দোকানির কারিকুরি শেষ হলে মায়ের কানে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘‘বাঁশি পিচকারি চাই।’’ কৃষ্ণনগর পোস্টঅফিস মোড়ে বসা সেই দোকানির মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের হাসি। হাসির ঢেউ খেলে মতি, মতির মায়ের মুখেও। গলিতে, পাড়ায়, বড় রাস্তা জুড়ে বসেছে রঙের দোকান। সেই সঙ্গে নানা বর্ণের নানা আকৃতির পিচকারি। সঙ্গে লাল, নীল চুলের ভয়াল মুখোশ। তাই কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় জমিয়েছে কচিকাঁচারা। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। কোথাও আবার চৈতন্যের জন্মভূমিতে দিনটি কাটাতে দেশ বিদেশ থেকে হাজির হয়েছেন ভক্তেরা। হাজার হাজার পূণ্যার্থীর ভিড়ে এখনই ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই রব নবদ্বীপ মায়াপুরে। তারই দু’চারটে ছবি রইল নীচে।
ভক্ত সমাগম
নবদ্বীপে গঙ্গার দু’পার এখন লোকে লোকারণ্য। গত বছর শুধু দোলের দিনই লাখ খানেক লোক পাড়ি জমিয়েছিলেন নবদ্বীপ-মায়াপুরে। এ বার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ। তাই ভিড় বাড়বে বই কমবে না। ইতিমধ্যে নবদ্বীপের প্রধান চারটি মঠ দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ, চৈতন্য সারস্বত মঠ, কেশবজি গৌড়ীয় মঠ বা জন্মস্থান আশ্রম মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি ভক্ত এসেছেন। নবদ্বীপ এবং সংলগ্ন অঞ্চল ঘুরে পরিক্রমা করেছেন। এ ছাড়া নবদ্বীপে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় শ’দেড়েক মঠমন্দির কমবেশি আরও পঞ্চাশ হাজার বহিরাগত রয়েছেন। প্রশাসনের মতে, শহরে কম করে লক্ষাধিক বহিরাগত মানুষ রয়েছেন। অন্য দিকে, মায়াপুরেও ঠাঁই নাই রব। দোলের দিন এ বার লাখ বেশি মানুষ আসবেন বলে অনুমান পুলিশের। ইস্কনের তরফে রমেশ দাস জানান, মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে সব কটি গেস্টহাউস উপচে পড়ছে।
ভোজ কয় যাহারে
প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ায় স্থানীয় বাজারও বেশ চাঙ্গা। দোলের পনেরো দিন রোজ গড়ে ২৫ হাজার লোককে তিনবেলা প্রসাদ খাওয়ায় কেশবজি গৌড়ীয় মঠ। মঠের ভারপ্রাপ্ত মধুসুদন ব্রহ্মচারী জানান, প্রসাদের জন্য প্রতিদিন গড়ে আট থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ হয়। একই ভাবে প্রতিটি মঠ-মন্দিরে কয়েক হাজার করে ভক্ত। জ্বালানি কাঠ বাদে সব কিছু নবদ্বীপের স্থানীয় বাজার থেকেই কেনা হয়। সব্জি, চাল, ডাল, তেল, চিনি থেকে শালপাতা, ভাঁড়। ফলে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘নবদ্বীপের ব্যবসায়ীদের কাছে এখন দোলই প্রধান উৎসব। মুদিখানা থেকে মিষ্টি, সব্জি থেকে নিত্য প্রয়োজনের তেল, সাবান, পেস্ট। রিকশা, টোটোচালক থেকে লেবুজল ফেরিওয়ালা, সবাই দিনের শেষে লাভের কড়ি গুনে বাড়ি ফিরেছেন।”
রঙবাজি বন্দুকবাজি
বহরমপুরের পঞ্চাননতলার ভিড়ে ঠাসা রাস্তার ধারে টেবিলপাতা অস্থায়ী দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গলার শির ফুলিয়ে ছেলেটা নাগাড়ে চিৎকার চলেছে, একশো টাকায় এ কে ফরটি সেভেন! দু’হাতে কাঁধে, গলায় ঝোলানো প্লাস্টিকের তৈরি বন্দুক পিচকারি। ছোট-বড় নানা মাপের বন্দুকের মতো দেখতে পিচকারিই এ বার দোলের বাজারে চুটিয়ে বিক্রি হচ্ছে। দাম দশ থেকে একশো। নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগরেও ফুটপাতে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে ওই পিচকারি বন্দুক।
নবদ্বীপের নন্দ রায় জানান, সব দামেই বন্দুক মিলছে। তাই বিক্রিও হচ্ছে বেশ। তবে রঙের বাজার খানিক চড়া। ভাল রঙ ৮০০-১২০০ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে। দাম চড়েছে ভেষজ আবিরেরও। একশো গ্রামের দাম ২০ টাকা। বাজারে ভাল কাটতি পতঞ্জলির আবিরের। ৩০ টাকায় একশো গ্রাম। টুপির বাজার দখল করেছে ‘চিনেরা’। কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপের বাজার ছেয়ে গিয়েছে চায়না টুপিতে। তবে এ বারে বাজারে নয়া চমক ঝাঁকড়া চুলওয়ালা টুপি। প্লাস্টিক টুপির পিছন দিকে কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে সোনালি চুল। দাম ৫০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। বহরমপুরে টুপি বিকোচ্ছে ফুটবলারদের নামে! কার্লোস, বেকহ্যাম, রোনাল্ডো-কে নেই সেই তালিকায়।
শেষ বেলার ভিড়
মঙ্গলবার বিকালে কৃষ্ণনগরের পোস্টঅফিস মোড়ে ভিড় ছিল উপচে পড়া। পোস্টঅফিস মোড়ে দোলের পসরা নিয়ে বসেছেন মদন দত্ত। তিনি জানান, ফুলের ব্যবসা করেন তিনি। কিন্তু দোলের সময় বাড়তি লাভের আশায় রঙ-মুখোশ নিয়ে বসে পড়েন। এক সময় শুধু আবির ও রং বিক্রি হত। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আবিরের পাশাপাশি টুপি, মুখোশ, পিচকারির চাহিদাও বাড়ছে। আরও এক দোকানি নিহার দাস বলেন, “এ বার খেলনা বন্দুকের আদলে পিচকারি, বাঁশির আদলেও পিচকারি বাচ্চাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।’’ একই কথা জানান, আরও এক ব্যবসায়ী স্বপন বিশ্বাস।
এ দিন মা ঈশিতা শীলের সঙ্গে আবির কিনতে এসেছিল বছর সাতেকের আমোদিতা। আবির, রঙ কেনার পাশাপাশি সে কিনেছে বিনুনি দেওয়া টুপি, পিচকারি। কৃষ্ণনগরে কাজে এসেছিলেন করিমপুরের সৌরভ মণ্ডল। বাড়ি ফেরার পথে ছেলের জন্য কিনলেন টুপি ও আবির। চোখাচোখি হতে একগাল হসে বললেন, ‘‘ছেলে দেখলে খুশি হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy