ধুয়ে গেল সেতু। রানাঘাটে (নীচে)। নিজস্ব চিত্র
বেলা যে গড়িয়েছে, ছায়াঘেরা আকাশ তা জানান দেয়নি।
সকাল সাড়ে ন’টা গড়িয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণনগরে আরশিপাড়ার পলাশ মিত্র বিছানা ছাড়েনি। মেঘমল্লারের বন্দিশ চলছে সদ্য কেনা ব্লু-ট্রুথ স্পিকারে।
পলাশের বাবা বেশ কয়েক বার উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেলেও বিশেষ ঘাঁটাচ্ছেন না। ঘাঁটাবেনই বা কেন? বাইরে যে ঝমঝমে বৃষ্টি! সকালের টিউশনে যাওয়ার তাড়া নেই। টিউশন থেকে ফিরে নাকে-মুখে গুঁজে স্কুলে পৌঁছনোর গুঁতো নেই। জীবন থেকে ব্যস্ততা ধুয়ে গিয়েছে টানা বৃষ্টিতে। ভিজে কাক হয়ে উদাসীন মন ঘাপটি মেরে বসে আছে কার্নিশে।
অনেকক্ষণ ধরেই বাড়ি ফেরার চেষ্টায় বৌবাজার পাড়ার হিমাংশু চক্রবর্তী। রোববার, সপ্তাহে এই একটাই ছুটির দিন। গরম চা আর রাহুল গাঁধীর ঝাপ্পি নিয়ে পোস্ট অফিস মোড়ের ঠেক জমজমাট। ছাড়তে মন চায় না। কিন্তু উপায় কী? সময় মতো ইলিশ নিয়ে বাড়িতে না পৌঁছলে দক্ষযজ্ঞ বাধবে। রবিবার দুপুরের ভাতঘুম মাটি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল! বন্ধুরা ঠাট্টা করেন। গায়ে মাখেন না তিনি— “রবিবার। বৃষ্টি। খিচুড়ি। ইলিশ। অমৃতযোগ! এ রসে তোরা বঞ্চিতই থাকলি রে।” বলেই দ্রুত সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেন।
ওঁদের ছোটবেলায় ঝমঝমে বৃষ্টি মানেই ছিল ইসকুলে রেনি-ডে। সে সুখ কবেই জীবন থেকে উধাও! কিন্তু রোববারে তুমুল বৃষ্টি নেমে সেই সুখই ফিরিয়ে দিয়েছে। পাত্রবাজারের মাছ বিক্রেতা জানাচ্ছেন, বৃষ্টিতে পাঁচশো গ্রাম ইলিশের দাম সাতশো থেকে সাড়ে চারশো-পাঁচশো টাকায় নেমে এসেছে। ছুটির দিনে যা উপরি পাওনা। তিনি বলছেন, “ইলিশের দাম কমায় ভালই ব্যবসা হচ্ছে।”
দুপুরে আইঢাই খিচুড়ি-ইলিশ ভোজ আর একটু গড়িয়ে নেওয়ার পর বিকেল থেকে কিন্তু আড্ডা জমজমাট। সদর মোড়ে কাকার দোকানে বিক্রি বেড়েছে চায়ের। ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বছর তিরিশের সজল পাল বলেন, “আড্ডা হচ্ছে ঠিকই। তবে ঝাঁঝ একটু কম।’’ পাশ থেকে ফুট কাটেন বন্ধু সঞ্জয়— “হবে না? পড়ে পাওয়া রেনি-ডে! পাতে হয় ইলিশ নয় মাংস-ভাত। ঘুম-ঘুম ভাব কাটতেই সন্ধে!’’
শনিবার রাত থেকেই আকাশ ফুঁড়ে নেমেছে বৃষ্টি। সারা দিন মেঘলা আকাশ। আর সন্ধে হতেই উল্টোরথের জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, রথের মেলা। বারান্দায় বা জানলার ধারে বসে সময় কেটেছে অনেকেরই। কেউ পাতা উল্টেছেন জয় গোস্বামীর— ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’। আবার গ্রিলের ফাঁক গলে নিজেকে ভিজিয়েছে ‘নগ্ন নির্জন’ কোনও হাত। এমন একটা রেনি-ডে মানে তো শুধুই আড্ডা হইচই নয়। একলা মনখারাপও। হাতছুট প্রেমের পালক লেগে থাকা কবিতাও। কারও কাছে যা হয়তো নিছকই বিষাদ-প্রেম। হবে হয়তো, মিছে তো নয়!
সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে। দূরে কোথায় যেন পঙ্কজ মল্লিক গাইছেন— ‘এমন দিনে তারে বলা যায়...।’
বৃষ্টির গুঁড়ো উড়ছে পথবাতির আলো ছুঁয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy