অন্য ভোজ: অতিথিদের দেওয়া হল গাছের চারা। ইনসেটে মেনুকার্ড। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র
আত্মীয়-বন্ধু সমাগমে, রোশনাই, নানা পদ, সাজগোজ চলুক, পাশাপাশি সেই জমায়েতেই যদি দেওয়া যায় পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতার বার্তা, যদি অন্তত কিছু মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয় শুভ বোধ, তাতে ক্ষতি কী?
একটু অন্য রকম ভেবেছিলেন কোতোয়ালি থানার দীগনগর এলাকার ব্যবসায়ী মানিক দত্ত। ২৬ এপ্রিল একমাত্র মেয়ে মনীষার বিয়ের অনুষ্ঠানকে শুধু হুল্লোড়-সর্বস্ব করতে চাননি।
বিয়ের আমন্ত্রণপত্রেই ছক ভেঙেছিলেন। সেখানে নাবালিকা বিয়ের কুফল নিয়ে বিস্তারে লেখা। আঠেরো বছরের নীচে কারও বিয়ে দেওয়া যে অপরাধ, তা-ও স্পষ্ট করে লেখা। আমন্ত্রিতরা বিয়েবাড়িতে আসার পরে তাঁদের জন্য আরও চমক। সুদৃশ্য মণ্ডপের সর্বত্র পরিবেশ রক্ষা নিয়ে বিশাল-বিশাল ফ্লেক্স টাঙানো। কোথাও রয়েছে বিলুপ্ত হতে বসা প্রাণীদের কথা, কোথাও আবার গাছ বাঁচানোর আর্জি। কোনও ফ্লেক্স জুড়ে প্লাস্টিকের কুফল আর দূষিত গ্যাস নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ।
বিয়েবাড়ির দরজা দিয়ে ঢোকার সময় আতরের ছিটে আর হাতে-হাতে গোলাপ পেতে অভ্যস্ত অভ্যাগতেরা আপ্যায়িত হলেন ছোট্ট-ছোট্ট চারাগাছে। সঙ্গে আন্তরিক অনুরোধ, ‘এটা বাড়ির আশপাশে কোথাও পুঁতবেন, যত্ন করবেন আপনার পরের প্রজন্মের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে’। খেতে বসে আবার নতুন অনুভব। খাবারের লম্বা তালিকার পাশে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ এর প্রচার। এক কোনায় জ্বলজ্বল করছে, ‘হেলমেট পরুন, সুরক্ষিত থাকুন’। আমন্ত্রিতরা চমৎকৃত, খেতে-খেতেই ফিসফাস, ‘‘মনে থাকবে এই উৎসব, তার সঙ্গে আমাদের ভুলে যাওয়া দায়িত্বগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার এই সুন্দর চেষ্টা।’’ তাঁদের অবাক হওয়ার তখনও বাকি ছিল। বিয়েবাড়ির একধারে বড় স্ক্রিন টাঙানো, সামনে সার-সার চেয়ার পাতা। প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, বুঝি নাচ-গানের অনুষ্ঠান, এ সব ক্ষেত্রে যেমন হয় আর কী! পরক্ষণে ভুল ভাঙে। স্লাইড শো শুরু হয় সাপের বিষ শরীরে ঢুকলে প্রাথমিক চিকিৎসা কী ভাবে দিতে হবে, তা নিয়ে। ওঝার বদলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রোগীকে অ্যান্টি ভেনাম দেওয়াটাই যে সঠিক সেটাই তুলে ধরা হল স্লাইডে। মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানকে সচেতনতা অভিযান চালানোর জায়গা হিসাবে বাছলেন কেন? মানিকবাবু বলেন, “দীর্ঘদিন বিজ্ঞান আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মানুষের মধ্যে এখনও সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে ভাবনার ঘাটতি রয়েছে। বিয়েতে প্রায় শ’ পাঁচেক লোক নিমন্ত্রিত, ভেবেছিলাম এঁদের মধ্যে এক শতাংশ কেও যদি সচেতন করতে পারি তা হলেও আমাদের আন্দোলন অনেকটা সফল হবে।’’ জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিবাহবার্ষিকীতে অনাথ শিশুদের খাওয়ানো, জামাকাপড় বিতরণ, রক্তদানের আয়োজন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আর বিয়ের ক্ষেত্রে এখন ‘থিম’ বা ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’-এর জোয়ার। এই সবকিছু মধ্যে কোথাও যেন দিন বদলের সৎ চেষ্টার ছোঁয়া দীগনগরের বিয়েবাড়িতে। বিয়ের দিন সকাল থেকেই পড়শিরা ভিড় করে হাজির হয়েছেন শুধু মণ্ডপ দেখতে। যারা এই কাজে মানিকবাবুকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে শান্তিপুরের সেই সায়েন্স ক্লাবের সদস্য অনুপম সাহা বলছেন, “এটা উদাহরণ হয়ে থাকল। এখন থেকে এই ধরনের আয়োজনে মানুষকে আরও উৎসাহিত করব যাতে তাঁরা এগিয়ে আসেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy