Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

টোপা কুল খেয়ে ফেল করার দিন গিয়েছে কবেই

কোনওটার সবুজ আপেলের মতো গড়ন, কোনওটা আবার চেরির মতো। বাজার ছেয়েছে নানা ধরনের হাইব্রিড কুলে। আর তার গুঁতোয় হারিয়ে যেতে বসেছে টক মিষ্টি, দাঁত শিরশির করা দেশি টোপাকুল। 

ঘাটের কাছে দেশি কুলের গাছ। কৃষ্ণনগরে জলঙ্গির তীরে। নিজস্ব চিত্র

ঘাটের কাছে দেশি কুলের গাছ। কৃষ্ণনগরে জলঙ্গির তীরে। নিজস্ব চিত্র

সুদীপ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

কোনওটার সবুজ আপেলের মতো গড়ন, কোনওটা আবার চেরির মতো। বাজার ছেয়েছে নানা ধরনের হাইব্রিড কুলে। আর তার গুঁতোয় হারিয়ে যেতে বসেছে টক মিষ্টি, দাঁত শিরশির করা দেশি টোপাকুল।

দেশি নারকেল কুলও আর মেলে না সে ভাবে। খুঁজে পেতে যা-ও বা মেলে তার আর সে জাত নেই, দামও হাইব্রিডের কুলের দ্বিগুণ। হাইব্রিড ‘বাও’ কুল যেখানে কুড়ি থেকে চল্লিশ টাকা কিলো, একটু ভাল দেশি টোপা কুল সেখানে আশি টাকা, আর দেশি নারকেল কুল দেড়শো টাকা।

অথচ এক সময়ে মাটিতে গড়াগড়ি যেত টোপাকুল। খাওয়ার লোক ছিল না— বলছেন দোকানিরা সরস্বতী পুজো ছিল কুল খাওয়ার ছাড়পত্র। তার আগে নুন ঠেকিয়ে টোপা কুল মুখে তুললেই পরীক্ষায় নির্ঘাৎ ফেল! সেই কুলও নেই, সেই ছেলেমানুষি বিশ্বাসও অনেকটাই গায়েব। সরস্বতী পুজোর অনেক আগে থেকেই বাজারে বিক্রি হয় হাইব্রিড কুল। স্কুলগেটের বাইরে বাও কুল লাল-হলুদ সস আর কাসুন্দি মাখিয়ে বিকোয় দেদার। ছোটরা ভুলেই গিয়েছে চুরি করে ঢিল ছুড়ে দেশি কুল পেরে, শিলনোড়ায় থেঁতো করে নুন-লঙ্কা মাখিয়ে খাওয়া।

আর দোয়াত তো হারিয়ে গিয়েছে দাদু-ঠাকুমার সঙ্গেই। এখন সব ‘ইউজ় অ্যান্ড থ্রো’। পুজো শেষ হতেই ফুল- বেলপাতার সঙ্গে জলাঞ্জলি হয়ে যায় মাটির দোয়াত। পরের বছর আবার নতুন করে কিনে নিলেই হল, কে-ই বা যত্ন করে তুলে রাখবে?

তাই সরস্বতী পুজোর মুখে এখন মাটির আর প্লাস্টিকের দোয়াতের ছড়াছড়ি। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে ঝর্না কলমের কালির চিনামাটির আর কাচের দোয়াত! প্রতি বছর পুজোর সময়ে একটা টিনের বাক্স থেকে সেই সব দোয়াত বের করে ধুয়ে পুজোয় দিতেন ঠাকুমা। পুজোর সময়ে পুরুত ঠাকুরের কোলে বসে স্লেট পেন্সিলে অ-আ লিখে হাতেখড়ি। আর মাঝে-মধ্যে টুক করে দেখে নেওয়া পাশেই পেতলের থালায় সাজানো কুল। কখন যে পুজো শেষ হবে!

রামুকাকার বাগানে একটা বড় দেশি কুলের গাছ ছিল। রোজ দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে ছেলেরা ঢিল ছুড়ে কুল পাড়ত। সারা দুপুর ধরে দাপাদাপি। মাঝে-মাঝে বিরক্ত হয়ে লাঠি হাতে ছুটে আসতেন রামুকাকা। যে যে-দিকে পারত ছুট লাগাত। একটু পরে রামুকাকা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেই ফের কুলতলায় জড়ো হওয়া। সেই সব কুলগাছই এখন শহর থেকে বিদায় নিয়েছে। গ্রামের দিকে রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে হয়তো খুঁজে-পেতে মিলতে পারে দু’একটা গাছ।

কৃষ্ণনগরের কাছেই আনন্দনগর গ্রামে একটা সময়ে প্রায় প্রতি বাড়িতে দেশিকুলের গাছ ছিল। গাঁয়ের পবন সরকার বলেন, ‘‘আমাদের বাড়িতেই তিনটে কুলগাছ ছিল। এখন আর একটাও নেই। গ্রামে কুলগাছ বলতে সেই পুকুরপাড়ে একটা, আর ওই স্কুলের পাশে রাস্তার ধারে। বাড়ির গাছগুলো আর নেই বললেই চলে।’’

‘‘দেশি কুল ছাড়া আচার হয় নাকি?’’— মনখারাপ করে বলেন ওই গ্রামেরই আরতিবালা সরকার। পাকা কুলে নুন-হলুদ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে গুড় দিয়ে তৈরি হত জিভে জল এনে দেওয়া আচার। সেই আচার ভরে রাখা হতো চিনামাটির আর কাঁচের বয়ামে, মাঝে-মাঝে বয়ামের মুখে সাদা কাপড় বেঁধে রোদে দেওয়া হতো। সেই আচার শোকানোর হ্যাপাও কম ছিল না। ছোটরা তো হামলে পড়তই, হনুমানের উৎপাত ঠেকাতে ঠায় বসে থাকতে হতো পাহারা দিয়ে। ‘‘এখন সে কুলও নেই, সে আচারও নেই। এক সময়ে কুল কুড়িয়ে আচার করেছি, এখন একগাদা দাম দিয়ে কিনে আচার করা পোষায় নাকি?’’ —বলেন আরতি।

কৃষ্ণনগরের লালদিঘির পারে কিছু দিন আগেও বেশ কিছু দেশি কুলের গাছ ছিল। সেগুলো কাটা পড়েছে। তবে ঘূর্ণীতে জলঙ্গির পারে তরুণ সঙ্ঘের ঘাটের ধারে কিছু দেশি কুলের গাছ আজও আছে। আগে একটাই ছিল, তা থেকেই এখন গোটা পাঁচেক গাছ হয়েছে। বছরের এই সময়টায় এখনও কচিকাঁচারা কুল পাড়তে ভিড় করে সেখানে।

আর চাষাপাড়ায় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিলের আড়ালে সোমা চাকির বাড়িতে একটা গাছ ভরে আছে বারোমেসে দেশি কুলে। সোমা বলেন, ‘‘সারা বছরই টুকটাক কুল হয়, কিন্তু স্বাদ মেলে এই সময়ে। এই সময়ে কুল পেরে শুকিয়ে আচারও করি। তবে ছোটবেলার টোপাকুলের সেই স্বাদ যেন আর পাই না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old Memories Nostalgia Jujube (Boroi Kul)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE