অঞ্জনা খালের এই ছবি কি বদলাবে? — ফাইল চিত্র
মুখ্যমন্ত্রী উৎসাহ দেখিয়েছেন। তাই শহরের নিকাশি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে অঞ্জনা নদীর সংস্কারের কাজ শুরু করল কৃষ্ণনগর পুরসভা।
শহরের ভিতরে প্রবাহিত অঞ্জনাকে সংস্কার করতে সমীক্ষা করতে শুরু করল পুরসভা। পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, অঞ্জনা যাতে আগে স্রোত ফিরে পায় তার বন্দোবস্ত করা হবে। সঙ্গে নদীর দু’ধারে সৌন্দর্যায়ণ করা হবে। নদী পাড়কে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পুরসভার দাবি, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সায় রয়েছে এই প্রকল্পে। পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, ‘‘খোদ মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন অঞ্জনার সংস্কার হোক। সেই মতো একটি সংস্থাকে সমীক্ষা করানো হয়েছে।’’
অঞ্জনা-সংস্কারের উদ্যোগ অবশ্য এই প্রথম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে মাঝেমধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে কিছু জায়গায় অঞ্জনার সংস্কার শুরু হয়েছিল। ১৯৫১ সালে নদিয়া জেলার তত্কালীন ম্যাজিস্ট্রেট মনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অঞ্জনার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে সেই চেষ্টা সেভাবে ফলদায়ক হয়নি। তবে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরের দক্ষিণে অঞ্জনার সামান্য সংস্কার হয়েছিল। ২০০৮ সালে কৃষ্ণনগর উত্তরের তৎকালীন বিধায়ক সিপিআই (এম) এর সুবিনয় ঘোষের বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থে সংস্কার শুরু হলেও সেভাবে অগ্রসর হয়নি জেলা প্রশাসন।
মাস কয়েক আগে বিধানসভা ভোটের প্রচারে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অসীমবাবুর দাবি, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে অঞ্জনার সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বলে কথা। এ বার অঞ্জনার সংস্কার হবেই।’’
আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে জলঙ্গি থেকে শাখানদী হিসেবে উত্পত্তি হয় অঞ্জনার। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-তে কিংবা বাংলা সাহিত্যেও এই নদীর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অঞ্জনার বেশিরভাগ অংশই দখলদারদের কব্জায় চলে গিয়েছে। কৃষ্ণনগর শহরের যাবতীয় বর্জ্য ফেলার এখন একমাত্র আধার এই নদী। মানুষের অত্যাচারে নদী আজ তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। কোথাও কোথাও নদী বিচ্ছিন্ন পুকুর বা দিঘির চেহারা নিয়েছে।
জলঙ্গির শাখানদী অঞ্জনা। কৃষ্ণনগরের কাছে ৫২ নম্বর রুইপুকুর মৌজা থেকে উৎপত্তি হয়ে অঞ্জনা কৃষ্ণনগরের প্রশাসনিক ভবনের পাশ দিয়ে ক্যাথিড্রাল চার্চের সামনে দিয়ে বেজিখালি মোড় হয়ে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল অতিক্রম করে দোগাছির কাছে পৌঁছেছে। সেখানে হাটবোয়ালিয়ার কাছে নদীটি দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। একটি অংশ জালালখালি, জলকর পাটুলি, বাদকুল্লা, চন্দনপুকুর হয়ে ৩৪ নম্বর ব্যাসপুর মৌজার কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। হেলেরখাল নামে পরিচিত অন্য অংশটি হাটবোয়ালিয়া থেকে যাত্রাপুর, জয়পুর, গোবিন্দপুর, ইটাবেড়িয়া, হয়ে হাঁসখালির কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে।
অঞ্জনা নদী তার স্বাভাবিক ছন্দ হারাতে শুরু করেছে সেই রাজা-রাজাদের আমল থেকেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, কৃষ্ণনগরের রাজা রুদ্র রায়ের সময়কালে (১৬৮৩-১৬৯৪) অঞ্জনার উপর প্রথম আঘাত নেমে আসে। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধা পায়। সেই ধারা আজও অব্যাহত। বেজিখালির মোড় থেকে হরিজনপল্লি পর্যন্ত কয়েকশো মিটার বিস্তীর্ণ রাস্তার ডান দিক দিয়ে প্রবাহিত অঞ্জনা এতটাই সরু যে নদী বলে মালুম হওয়া দায়। রাস্তার মাঝে পুরসভার টাঙানো হোর্ডিংয়েও অঞ্জনাকে নদী বলে উল্লেখ নেই। সেখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, “অঞ্জনা খাল ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ এই খালে মাটি বা অন্যান্য সামগ্রী ফেলিয়া ভরাট করার চেষ্টা করলে পুরসভা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।”
কিন্তু সে সতর্কবার্তাই সার। নদীতে দেদার ফেলা হচ্ছে নোংরা,আবর্জনা। নদীর বুকে মাটি ফেলে গজিয়ে উঠেছে বহুতল বাড়ি। বেজিখালি মোড়েই নদী বুজিয়ে তৈরি করা হয়েছে আবর্জনা ফেলার ‘ভ্যাট’। সেখানে গৃহস্থালীর দৈনন্দিন নোংরা ফেলা হচ্ছে নিয়ম করে। আশপাশের দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, চায়ের ভাঁড়, অপ্রয়োজনীয় ফ্লেক্স-ব্যানার সবই পড়ছে নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা ভ্যাটে। আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে মিটার তিরিশেক দূরে নদীবক্ষেই তৈরি হয়েছে দোকানপাট। সেখানে নদীর অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে ওঠা আগাছা, ঘন কচু বন নদীকে ঢেকে দিয়েছে। কচু বন পেরিয়ে নদীর গতিপথকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে তৈরি হয়েছে পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে সঙ্কীর্ণ অঞ্জনা পুনরায় আঁকাবাঁকা পথে যাত্রা শুরু করে পৌঁছেছে শক্তিনগর হাসপাতালের কাছে। ২০০৪ সাল নাগাদ জেলা হাসপাতালে গোটা পাঁচেক নিকাশি-নালা তৈরি হয়। সেই নালা দিয়ে হাসপাতালের সমস্ত বর্জ্য প্রতিনিয়ত গিয়ে পড়ছে নদীতে। এমনকী শহরের বেশিরভাগ জায়গারই নোংরা জল নালার মাধ্যমে এসে মিশছে নদীতে।
ভোট আসে ভোট যায়। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অঞ্জনাকে নিয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেয়। কিন্তু ভোট মিটে গেলে সেই প্রতিশ্রুতি বন্যার জলের মতোই অঞ্জনার মজে যাওয়া খাত দিয়ে বয়ে গিয়েছে এত দিন। নাগরিক সমাজের তরফে এ হেন শীর্ণকায়া অঞ্জনার হাল ফেরাতে বার বার দাবি উঠেছিল। সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করছিলে পুর কর্তৃপক্ষও। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়া পরই সংস্কারে উদ্যোগী হয় পুরসভা। পুরপ্রধান জানিয়েছেন, নদীর দুই পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হবে। নদীর জলের বহমানতার পাশাপাশি দুই পাড়ে সৌন্দর্যায়ণ করা হবে। গাছ লাগানো হবে। থাকবে সুদৃশ্য আলো। বয়স্কদের জন্য বসার জায়গা। আর নদীর বুকে থাকবে প্যাডেল বোট।
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘একটা ভালো উদ্যেগ। কারণ গোটা শহরের নিকাশি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই নদীর উপরে। বিশেষ করে বর্ষা বা বন্যার সময় এই নদীর জল নিকাশির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার জন্য প্রথমেই নদীকে বেআইনি নির্মাণ মুক্ত করতে হবে।’’ সেটা কী ভাবে করবে পুরসভা? অসীমবাবু বলেন, ‘‘আমি অবশ্যই নদীকে দখলমুক্ত করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy