Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিচারকের নাম করেও টাকা নিচ্ছে দালাল

বধূহত্যায় অভিযুক্ত হয়েছিল রেজিনগরের লোকনাথপুরের এক পরিবার। পরিবারের তিনজনের আগাম জামিনের জন্য আদালতে আবেদন করেন তাঁদের আইনজীবী। জামিন মঞ্জুরও হয়। কিন্তু আইনজীবীর ফি দিতে অস্বীকার করে অভিযুক্তরা।

বহরমপুরে আদালত চত্বরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বহরমপুরে আদালত চত্বরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৮
Share: Save:

বধূহত্যায় অভিযুক্ত হয়েছিল রেজিনগরের লোকনাথপুরের এক পরিবার। পরিবারের তিনজনের আগাম জামিনের জন্য আদালতে আবেদন করেন তাঁদের আইনজীবী। জামিন মঞ্জুরও হয়। কিন্তু আইনজীবীর ফি দিতে অস্বীকার করে অভিযুক্তরা। তাঁদের দাবি, গ্রামের এক পঞ্চায়েত সদস্য পুলিশের সঙ্গে মোটা টাকার রফা করায় জামিন মিলেছে। আইনজীবীকে তারা উল্টে প্রশ্ন করে, ‘‘আপনি কী করেছেন?’’

মুর্শিদাবাদের জেলা আদালত, এবং বিভিন্ন মহকুমা আদালতে দালালদের চাপে নাভিশ্বাস উঠছে আইনজীবী আর বিচারপ্রার্থী, দুই তরফেরই। প্রবীণ আইনজীবী কাঞ্চনলাল মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘পুলিশ, পেশকার, মুহুরি, সকলেই দালালচক্রের সঙ্গে জড়িত।’’ তাঁর অভিযোগ, ফৌজদারি কোর্টে খাতা হাতে একশ্রেণির দালাল ঘুরে বেড়ায়, যারা নিজেদের মুহুরি বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু ওদের কাজ হচ্ছে দালালি। উকিল, পুলিশ, এমনকী বিচারকের নাম করেও মক্কেলের থেকে টাকা নিচ্ছে তারা।

কী ভাবে কাজ করছে এই দালালচক্র? আইনজীবীদের একাংশ জানালেন, দালালরা বিশেষ করে নিশানা করে অভিযুক্তদের। গ্রামে কোনও মামলা হলেই তারা সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। জামিন পাইয়ে দেওয়া, মামলা হালকা করে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। বিপদের সময়ে মানুষ তাদের উপরে ভরসা করে বসেন। কিন্তু তারপরেই ক্রমাগত টাকা দাবি করতে থাকে এই দালালেরা। তাদের দাপটে অনেক সময়ে আইনজীবীর দেখাও পায় না মক্কেলরা। কেবল ওই মধ্যস্থতাকারীর ভরসায় মামলা চালাতে হয় তাদের।

প্রতারিত হচ্ছেন আইনজীবীরাও। জেলা জজ আদালতের এক আইনজীবী জানান, ‘‘দালালরা গ্রাম থেকে মক্কেল ধরে আনে। মক্কেলের সঙ্গে কত টাকায় রফা করে, তা-ও জানার উপায় থাকে না। হাতে যা দেয় দালাল, তাই নিতে হয়। মাঝে ওরা মোটা টাকা কামিয়ে নেয়।’’

আইনজীবীদের একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও এখন দালালির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বহরমপুরের আইনজীবী পীযূষ ঘোষ বলেন, ‘‘গ্রামে কোনও ঘটনা ঘটলে দু’পক্ষ দুই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে চলে যায়। শাসকদলের কাছে গেলে অভিযুক্তদের পুলিশের চাপ সহ্য করতে হবে না বলে মনে করে অভিযুক্তরা। অভিযুক্তপক্ষের সঙ্গে পুলিশের আর্থিক রফা করে মোটা টাকা কামানো যাচ্ছে খুব সহজেই। ফলে অনেক নেতা এই কাজে উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।’’

একই ভাবে, দালালরা মক্কেলকে বোঝাচ্ছে যে তাদের টাকা দিলে পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট ঠিক সময়ে আদালতে পাঠানো হবে, রিপোর্টে অপরাধ লঘু করে দেখানো হবে। জেলা জজ আদালতে কোনও মামলার আগাম জামিন বা বিচারাধীন বন্দির জামিনের জন্য আবেদন করা হলে বিচারক তদন্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠান তদন্তকারী অফিসারের কাছ থেকে। তখনই দালালের আগমন ঘটছে। দালালকে টাকা না দিলে মামলা এগোনোর উপায় নেই, এই ধারণা থেকে আইনজীবীদের উপর মক্কেলদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে আইনজীবীদের ক্ষোভ।

পশ্চিমবঙ্গ ল-ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি সাইনুদ্দিন হক অভিযোগ করেন, ওই দালালচক্রের পিছনে কিছু আইনজীবী আছেন। কিছু অভিযুক্ত ও আসামিও রয়েছে, যারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দালালি শুরু করেছে। তাদের জন্য মুহুরিদের বদনাম হচ্ছে, আক্ষেপ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দালালদের এতটাই দুঃসাহস যে ‘বিচারককে টাকা দিতে হবে’ বলে বিচারকের নাম করে দুই পক্ষের কাছ থেকেই টাকা নিচ্ছে।’’ এক শ্রেণির আইনজীবী ও সিনিয়র মুহুরিদের জন্য ওই সব দালাল চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা যাচ্ছে না বলেও আক্ষেপ করেন সাইনুদ্দিনবাবু। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি থানার সামনে দালালরা অস্থায়ী কার্যালয় খুলে বসে আছে। আসল মুহুরিদের পক্ষে কি আদালতের কাজ সামলে তা করা সম্ভব?’’

বিষয়টি তিনি জানেন না, দাবি করেছেন পুলিশ সুপার সি সুধাকর। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে ওই ব্যাপারে কোনও লিখিত অভিযোগ কেউ কোনও দিন করেনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lawyer court agent money west bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE