Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
‘চেঁচিয়ে পাড়া মাত করো’

মদ খেয়ে বাবা বড্ড মারে স্যর

ছেলেটা প্রথমে হাত তোলে, তার পর হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে—  ‘‘স্যার, বাবা রোজ মদ খেয়ে এসে আমাদের মারধর করে।

প্রশ্ন-বাণ: রঘুনাথগ়ঞ্জে। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন-বাণ: রঘুনাথগ়ঞ্জে। নিজস্ব চিত্র

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৩
Share: Save:

ছেলেটা প্রথমে হাত তোলে, তার পর হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে— ‘‘স্যার, বাবা রোজ মদ খেয়ে এসে আমাদের মারধর করে। গ্রামে মদ বেচাকেনা চলছেই, আর বাবা রোজ খাচ্ছে...মারছে।’’ ছেলেটা এ বার সটান তাকায় জেলা কর্তাদের অস্বস্তিতে পড়া ভিড়টার দিকে। খানিক চুপ করে থেকে সাগরদিঘির সেই কিশোর জানতে চায়, ‘‘কিছু করবেন স্যার?’’

‘শিশুদের অধিকার সুরক্ষা সভা’— প্রশাসনিক আধিকারিকদের ভিড়, টেবিল, মাইক, গলা খাকারির মধ্যেই, প্রশ্ন এল, ‘‘তোমরা আগে তোমাদের অসুবিধার কথা বল তো।’’

একে একে এমনই পাল্টা অস্বস্তি উড়ে এল তাঁদের দিকে। যা শুনে তাঁরা কেউ চশমার কাচ মুছলেন। কেউ বা খানিক উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকলেন জানলার দিকে। তারা কেউ নিরন্তর ইভ টিজিংয়ের শিকার, কেউ বা চায়ের দোকানে কাজ করে চরম হেনস্থা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কাজ করে সস্তার হোটেলে, কেউ ইটভাটায়। তাদের নাবালিকা বিয়ে বন্ধ, শিশুদের পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন করতে গিয়েই আধিকারিকদের পড়তে হল এমন বিড়ম্বনার মধ্যে।

এই বিপন্নতা নিয়ে জঙ্গিপুর মহকুমার বিড়ি শ্রমিক অধ্যুষিত সাতটি ব্লকের অবস্থা সম্পর্কে তিন পাতার একটি দাবিপত্রও এ দিন তারা তুলে দিয়েছে সভায় উপস্থিত পুলিশ কর্তা, সহকারি শ্রম কমিশনার ও প্রশাসনিক কর্তাদের হাতে। এই দাবি পত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত অস্বস্তির ছবি। অস্বস্তিতে পড়া সরকারি কর্তারা অবশ্য সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কোনওরকমে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

শিশু সুরক্ষা ও বাল্য বিবাহ নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে মহকুমার সাতটি ব্লকের কিশোর, কিশোরীদের এই সভার আয়োজন করা হয়েছিল শুক্রবার, যার শীর্ষক ছিল ‘চেঁচিয়ে পাড়া মাত করো’। বিভিন্ন ব্লক থেকে প্রায় ১২০ জন ছেলে-মেয়ে যোগ দেয় এ দিনের সভায়। তবে ঘন্টা তিনেকের সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছে জনা পনেরো। তাদেরই এক জন শমসেরগঞ্জের রেবন্নারা খাতুন এ দিন সরাসরি প্রশ্ন তোলে, “একের পর এক বাল্য বিবাহ বন্ধ হচ্ছে। মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু দিন পরেই গোপনের তাদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও নজরদারির ব্যবস্থা নেই কেন?”

ফরাক্কার দুলালি মন্ডলের অভিযোগ, “বিড়ি বাঁধা শ্রমআইন লঙ্ঘনে না-পড়ায় বাড়িতে বিড়ি বাঁধতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, ফলে স্কুলে যাওয়া অনিয়মিয়ত হয়ে পড়ছে আমার মতো অনেকের।’’ সুতি ব্লকের নাজেমা খাতুনের অভিযোগ, “কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতায় মাধ্যমিকের আগেই স্কুল ছাড়ছে বহু ছাত্রী। অল্প বয়সে কাজে চলে যাচ্ছে ছেলেরাও। ফলে সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে ছাত্রদের সংখ্যাও কমছে।”

এই সব অভিযোগে কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই উত্তর দিয়েছেন সকলেই নিজের মতো করে। সহকারী শ্রমকমিশনার শ্যামাপ্রসাদ কুন্ডু বলেন, “শিশুরা হোটেল , রেস্তোরাঁয় কাজ করছে দেখলেই আমাদের জানাও আমরা ব্যবস্থা নেব।” জঙ্গিপুর পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর উদয়শঙ্কর মণ্ডল এ দিন তার নিজের ফোন নম্বর তুলে দিয়েছেন কিশোরীদের হাতে। অভয় জুগিয়েছেন, “কোথাও কোনও সমস্যা হলে, পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে আমাকে নির্ভয়ে ফোন করবে। আমি দেখব।”

আয়োজক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জেলা প্রকল্প আধিকারিক শ্রাবণী মুখোপাধ্যায় বলছেন, “ সাতটি ব্লকের শিশুদের সঙ্গে কথা শুনলেন বুঝলেন ওরা কেমন আছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Meeting Child Rights Question
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE