শুশ্রূষা। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র
ডিসেম্বরের হাড়-কাঁপানো শীত। রাত গভীর। রাস্তাঘাট শুনশান। গোটা শহর ডুবে আছে ঘুমে। শুধু রাত জাগছেন তিন যুবক। রাস্তার পাশে থাকা অসুস্থ এক পথকুকুরের জন্য। তার স্যালাইন চলছে। ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি হচ্ছে না।
‘‘মরে যাবে না তো?’’
উৎকন্ঠায় প্রশ্নটা করে বসলেন এক যুবক। চকিতে তাঁর দিকে ফেরেন কুকুরের সেবাকারী মানুষটি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, “না, যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে।”
সে দিনের সেই কুকুরটিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাযনি। তবে, এ ভাবেই কৃষ্ণনগর শহরের অলিতেগলিতে থাকা এমন বহু অসুস্থ কুকুর তাঁর চেষ্টায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়— বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৮০। তিনি কৃষ্ণনগরের চকেরপাড়ার বাসিন্দা অতনু দাস। একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। রাস্তায় কোনও কুকুরের অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার খবর পেলেই যিনি ছুটে যান। চিকিৎসা করেন। কোনও দিকে আর খেয়াল থাকে না তাঁর।
দিন কয়েক আগেও চাষা পাড়ার ভিতরে পড়ে থাকা একটি মৃতপ্রায় কুকুরকে তুলে এনেছিলেন কৃষ্ণনগরের পোস্ট অফিসের ভিতরে। ঘাড়ের কাছে বিরাট গর্ত। দগদগে ঘায়ে জন্মেছে ম্যাগট। দুর্গন্ধে টেকা দায়। আর সেই সঙ্গে অপুষ্টি। শুরু হল চিকিৎসা। এগিয়ে এলেন স্থানীয় কয়েক জন যুবক। সকলের মিলে চলল প্রয়োজনীয় সমস্ত চিকিৎসা। দেওয়া হল পুষ্টিকর খাবার। শেষ পর্যন্ত চাঙ্গা হয়ে সেই কুকুর আবারও ফিরেছে রাস্তায়।
অতনুর এমন নানা ঘটনার সাক্ষী কৃষ্ণনগরের মানুষ। প্রায় দশ বছর ধরে চলছে তাঁর এই পশুসেবা। জানালেন, ২০০৮ সালে শুরুটাও হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। রাতে সিএমএস স্কুলের সামনে একটি গোরুর পায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল লরির চাকা। এক বন্ধুকে নিয়ে সারা রাত সেই রক্তাক্ত গোরুর সেবা করে সকালে হাজির হয়েছিলেন পশু হাসপাতালে। সেখানেই আলাপ হয়েছেল পশুচিকিৎসক অমলেন্দু সাহার সঙ্গে। সেই শুরু। চিকিৎসকের কাছ থেকে শিখে নেন পশুদের সেলাই করা থেকে স্যালাইন দেওয়া। শিখতে থাকেন ওদের চিকিৎসার নানা দিক। সেই সঙ্গে চলে পশুদের চিকিৎসা নিয়ে পড়াশুনো।
তার পর গোটা বিষয়টাই যেন নেশার মতো হয় ওঠে তাঁর কাছে। রাস্তার পাশে কোন অসুস্থ কুকুরকে দেখলেই লেগে পড়েন চিকিৎসার কাজে। বসে পড়েন ওষুধপত্র নিয়ে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চলে চিকিৎসা। তাঁর এই আন্তরিকতা দেখে জুটে যায় শহরের বেশ কয়েক জন যুবকও। তাঁরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাশে দাঁড়িয়েছেন অতনুর।
এলাকাতেই দীর্ঘ দিন ধরে পথ কুকুরদের দেখাশোনা করে আসছেন শুভ্রাংশু ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “রাত নেই, দিন নেই। মানুষটাকে যখনই ডেকেছি, ছুটে এসেছেন। কোনও কথা না বলে খুলে বসেছেন ওষুধের বাক্স। মানুষটার আন্তরিকতা শেখার মতো।”
কিন্তু সবটাই যে সহজ ভাবে সম্ভব হয়, এমনটাও নয়। কখনও কখনও স্থানীয় বাসিন্দারা আপত্তি করেন। আবার, কখনও আহত-হিংস্র কুকুরের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাদের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু কোন কিছুই অতনুকে থামাতে পারেনি।
কেন এমন ঝুঁকি নিয়ে এ সব করেন? পোস্ট অফিসের মোড়ে অসুস্থ এক কুকুরের মুখের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি বলেন, “এরা তো অসহায়। কাউকে তো একটা এগিয়ে আসতে হবে। তাই আমিই এলাম!”
মাস কয়েক আগে তিনি বেশ কয়েক জনকে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন। এখন সেই গ্রুপের সদস্যেরাও নানা ভাবে তাঁকে সাহায্য করছেন। এখনও পথকুকুরদের বাঁচিয়ে রাখতে এ ভাবেই লড়ে চলেছেন অতনুর মতো কেউ কেউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy