Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
নববর্ষের আগের দিন বাড়ির পুকুরে জাল পড়ত। পাতে মাছ যে চাই-ই চাই

শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বর্ষবরণ

স্মৃতির বয়স কিছুতেই আঠারো পেরোয় না। কনক দাস এমনিতে চুয়াত্তর অতিক্রম করলে কী হবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল থেকেই মনে মনে তিনি পৌঁছে যান নবদ্বীপ ছেড়ে ঢাকার কলাকোপা গ্রামে। তখন তিনি অষ্টাদশের ছোঁয়ায়।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০৬
Share: Save:

স্মৃতির বয়স কিছুতেই আঠারো পেরোয় না। কনক দাস এমনিতে চুয়াত্তর অতিক্রম করলে কী হবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল থেকেই মনে মনে তিনি পৌঁছে যান নবদ্বীপ ছেড়ে ঢাকার কলাকোপা গ্রামে। তখন তিনি অষ্টাদশের ছোঁয়ায়।

পয়লা বৈশাখ এলেই মনে পড়ে যায়, সেই চৈত্র সংক্রান্তির কাকভোরে কীর্তিনাশায় স্নান সেরে নতুন পোশাক পড়ে বাড়ির সবাই হাতজোড় করে গৃহদেবতার সামনে দাঁড়ানো। পুজো শেষে ভাইদের হাতে বোনেরা তুলে দিতেন যবের ছাতু। সে দিন যবের ছাতু খেতেই হত। খুব মজা হত বছরের শেষ বিকেলে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাসে ছাতু ওড়ানোর সময়। মেয়েরা সুর করে ছড়া কাটতেন ‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই’। এর পর শুরু হত নদীর জলে একে অপরকে ভিজিয়ে দেওয়ার খেলা।

১৩৭০ সালে বাংলাদেশ ছাড়েন কনক দাস। ঢাকার বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে কনক। মধ্যসত্তরে এসেও এতটুকু ফিকে হয়নি স্মৃতি। পূর্ববঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তিকে অনেক জায়গায় ছাতু সংক্রান্তি বলা হয়। কনকদেবী জানান, মা-ঠাকুমারা যবের ছাতুর সঙ্গে দই-নুন-চিনি বা ছাতুর সঙ্গে শুধু দুধ দিয়ে কিংবা ছাতুর সঙ্গে ক্ষীর বা অন্যান্য মিষ্টি দিয়ে অসাধারণ সব খাবার তৈরি করতেন। তাঁর অক্ষেপ, “লাড্ডুর কাছে সে সব খাবার হেরে গেল।”

এ পার ওপার দুই বাংলা জুড়েই চৈত্র সংক্রান্তির হরেক নাম। বাংলা পঞ্জিকাতে এই দিনটি মহাবিষুব নামে চিহ্নিত। বাকি নামগুলির সঙ্গে একটা করে উৎসবের ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে। কোথাও পাঁচকুমার কোথাও ফলগছানো, কোথায় আবার এয়ো সংক্রান্তি কোথাও মধু সংক্রান্তি। নানা ব্রতপার্বণের মধ্যে দিয়ে বছরের শেষ দিন থেকেই নতুন বছরের উৎসবের সুরটা বেঁধে দেওয়া হয়। সকালে ব্রতপালনের পর দুপুরে জমজমাট খাওয়াদাওয়া।

চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গেলেও ও-পার বাংলার নববর্ষের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল ডোমকলের প্রমীলা বিশ্বাসের। বছর সত্তরের বৃদ্ধা জানান, বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। প্রমীলাদেবী বলেন, “বাড়ির সকলেই ছিলেন খাদ্যরসিক। ফলে আয়োজনও হত তেমনই। খাওয়া-দাওয়া, হইচই করেই শুরু হত বছরের প্রথম দিন।” আর এখন? নববর্ষ মানে শুধুই স্মৃতি।

গ্রামের নাম সিদ্ধিপাশা। অবস্থান খুলনা ও যশোরের সীমানায়। গ্রামের প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠবিহারী কর। গ্রামের সবাইকে নিয়ে বিরাট করে নববর্ষ উদযাপন করতেন। নববর্ষের আগের দিন থেকেই বাড়ির পুকুরে জাল পড়ত। জেলেদের বলা ছিল প্রত্যেকের পাতে সমান মাপের কই দিতে হবে। সুতরাং সেই মতো মাছ চাই। সঙ্গে ইলিশের মাথা আর গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মুড়ি ঘণ্ট। ডুমো ডুমো করে কাটা আলু। নামানোর আগে ঘি গরমমশলা। ও-দিকে বড় বড় পাথরের ‘খোড়ায়’ ঘরে পাতা সাদা দই। নববর্ষের দুপুরের সেই মাথা-বড় যশুরে কইমাছের ‘তেল কই’ বা ইলিশের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্টের বাস যেন এখনও বীণাপাণি দেবীর নাকে লেগে আছে। বীণাপাণি নন্দী গোষ্ঠবিহারীর ছোট মেয়ে। পঁচাশি বছরের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করে নববর্ষের সকালে মিহি ধুতি পড়া বাবার চেহারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poila Baisakh Memories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE