Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মুখোমুখি বসিবার মুঠোফোন

মাঝে রাস্তা। ওপারে কলেজ। উল্টো দিকে ছিপছিপে নদী। ভাব হওয়ার আগে, ওরা কলেজেই— কখনও ক্যন্টিনের শেষ টেবিলে। কখনও আবার, ল্যাবের পিছনে, শ্যাওলা ধরা সিঁড়িটায়। —কী এত কথা বলে রে!

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০৬:৫৬
Share: Save:

মাঝে রাস্তা। ওপারে কলেজ। উল্টো দিকে ছিপছিপে নদী।

ভাব হওয়ার আগে, ওরা কলেজেই— কখনও ক্যন্টিনের শেষ টেবিলে। কখনও আবার, ল্যাবের পিছনে, শ্যাওলা ধরা সিঁড়িটায়।

—কী এত কথা বলে রে!

হই হই সহপাঠীরা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগে, ভাসিয়ে দেয় চিমটি, ‘‘দেখিস বাবা, এ-ওর মধ্যে হারিয়ে যাস না যেন!’’

বছর পাঁচেক আগের সেই কলেজ, এখনও অবিকল আগের মতো। সেই ক্যান্টিন, পলেস্তরা খসা সিঁড়ি। চৈত্রের কোকিল, মাঘের দুপুর—সেই সব নিরালা ঠিকানা এখন একা একা পড়ে থাকে। মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে!

এখনও বসে, ওরা-তারা-তাহারা। সক্কলে। মুখোমুখি নয়, একেবারে নীল ভাসা ভাসা চোখে চোখ রেখে। মোবাইল অ্যাপস-এ ঠাসা ছিপছিপে স্মার্ট ফোনের।

এই তোর’টা কত রে?

—ফোর জি, তবু কাল বিকেল থেকে সাড়া নেই।

টাওয়ার পাচ্ছিস?

—তোকে মেল’টা ফরওয়ার্ড করেছি। দেখে নিস।

হারিয়েছে হইহই আড্ডা। এখন সবাই আত্মমগ্ন অ্যাপসে। — নিজস্ব চিত্র

কেউ তাকায় না। নতমুখ, ছেঁড়া-ছেঁড়া, টুকরো কথন, এ-ওকে বার্তা পাঠায়, গ্রহণ-বর্জনের। কেউ ‘অ্যাকসেপ্ট’ করে, কারও বা স্মৃতি (মেমরি) ভারী হয়ে গেছে, আঙুলের মৃদু চাপে, বেমালুম ‘ডিলিট’।

হারানো বার্তা— কলেজ ক্যান্টিন, রিকশা পথের মফস্সল, বাবুদার চায়ের দোকান, ব্যারাক স্ক্যোয়ারের মাঠ ছাড়িয়ে দূরে, আরও সুদূরে, ডানা ঝাপটে ঝাপটে হারিয়ে যায়।

কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের নেড়া মাঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘তেরো বছর পরে কলেজে পা রেখে মনে হচ্ছে, এ-ওকে পাঠানো হারানো বার্তাগুলো এখন মরা কোকিলের মতো ডাকে জানেন, ‘ভারচুয়াল-ভারচুয়াল!’’

সে ডাকে কান পাতলে কী কান্নার আওয়াজ পান? বহরমপুর কেএন কলেজের রোগা টিংটিঙে ছেলেটি দশ বছরের প্রবাসে পাক্কা সরকারি চাকুরে হয়ে উঠেছেন। বলছেন, ‘‘ঠিকই বলেছেন, এই ভারচুয়াল দুনিয়ায় কান্নাই পায়! এখন তো ছেলে-মেয়েরা পরস্পরকে ভালবাসে না। সেলফিতেই তাদের আত্মরতি!’’

তেলচিটে ময়লায় কালো হয়ে যাওয়া কাঠের টেবিলটার চার দিকে ঘিরে থাকা মুখগুলো কবিতা নিয়ে খুব তর্ক জুড়েছে। সস্তার নিউজপ্রিন্টে তাদের পত্রিকার প্রথম সংস্কারণ বেরোচ্ছে, ‘ঘনমেঘ’।

পাশেই টেবিল বাজিয়ে রফি-মান্নার কে দড়, আর একটু তফাতে মাওবাদের খুঁটিনাটি ত্রুটি— বছর আটেক আগেও কৃষ্ণনগরের যে কলেজ ক্যান্টিনে এ ছবি প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল, এখন সেখানে মাথা নিচু করে স্মার্টফোন চর্চা।

বহরমপুরের চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত ১৯৯৫ সালে কলেজ ছেড়েছেন। স্মার্ট জগতের বাসিন্দাদের নিয়ে বলছেন, ‘‘হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের অলৌকিক ভাসমান অবস্থার মাঝে বসবাস। এ হল পরস্পরের সম্পর্ক রহিত বেঁচে থাকা।’’

কলেজে ওয়াই-ফাই-এর ছায়া পড়লে ছেলে-মেয়েরা আরও ভার্চুয়াল হয়ে পড়বে না তো? মনে হচ্ছে তাঁর।

নদিয়ার কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন বহরমপুরের ‘ব্রীহি’ নাট্যসংস্থার দীপক বিশ্বাস। ১৯৭৮ সালে কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজ ছেড়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘কলেজে ওয়াইফাই-এর সুবিধা ছাত্র জীবনে উপকারের থেকে অপকার করবে অনেক বেশি। স্মার্ট দুনিয়ায় সরাসরি মত চলাচলের সুযোগটাই নেই বুঝি। সেখানে জ্ঞান নেই, আছে তথ্যের কচকচি।’’

বছর তিনেক হল বহরমপুর কলেজ ছেড়েছেন বহরমপুরের মৌতৃষা পাল। তিনি অবশ্য মনে করেন, ‘‘লেখাপড়ার মান যা-ই হোক না কেন, মিডডে মিলের টানে স্কুলে পডুয়াদের ভিড় বেড়েছে। তেমনই ওয়াই-ফাই-এর টানে কলেজে ছাত্রছাত্রীর ভিড় বাড়বে দেখবেন।’’

কৃষ্ণনগরের দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজের অধ্যক্ষ শাহজাহান আলিও মনে করেন, ‘‘যে সব ছেলেমেয়ে পড়াশুনোয় ‘সিরিয়াস’ তারা এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সহজে নিজেদের সমূদ্ধ করতে পারবে। কারণ কোন খরচ ছাড়াই তারা প্রচুর ডাউনলোড করতে পারবে।’’

পঠন পাঠনের মান কি তাতে বাড়বে? হাসছেন সদ্য পাশ করা তরুণী। জানা নেই তাঁর।

কিন্তু কলেজে-কলেজে ওয়াই-ফাই শুনে সদ্য মাস্টারমশাইটি বলছেন, ‘‘কলেজের চৌকাঠ, সিড়ি, সেই সব গোপন গাছতলায়— মুখোমুখি বসিবার বদলে স্মার্টফোন হাতে দুরন্ত ফোর-জি যোগসূত্রকে কী নামিয়ে বসবে, তার ফলই বা কী হবে, সে কথা ভেবে কি দেখেছে শিক্ষা দফতর?’’

বরং কপাল কুঁচকে আরও সরাসরি বলছেন, বেলডাঙার এক শিক্ষক, ‘‘নেট যোগের দৌলতে কলেজগুলি শিক্ষার বদলে লঘু রুচির আামদানি বেশি হবে নাতো?’’

সত্তরের দশকে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদের প্রাক্তন জিএস ছিলেন স্বদেশ রায়। কলেজে ওয়াই-ফাই-এক ‘দাপট’-এর আমদানি শুনে বলছেন, ‘‘এ সব আসলে ছাত্র-ছাত্রীর মন জয়ের নয়া ফন্দি। নতুন মন তো, তারা যাতে সিরিয়াস কিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা না করতে পারে। যাতে ইন্টারনেটের লঘু জগতের ভিতরে মগ্ন থাকতে পারে, তারই চেষ্টা।’’

স্বদেশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘নতুন প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করে দাও তাহলেই কেল্লাফতে।’’

ওই কলেজের অন্য এক প্রাক্তনী মনে করতে পারছেন, অনেক দিন পরে তাঁর কলেজে পা রাখার স্মৃতি— ‘‘বহু দিন পরে একটা বিশেষ কাজে কলেজে গিয়ে দেখি আমরা যে সিঁড়িতে যে ভাবে বসে আড্ডা মারতাম এখনকার ছেলেমেয়েরাও সেই একই ভাবে বসে আছে। কিন্তু গল্প করছে না। মাথা নিচু করে নেট সার্ফ করছে। ভাবতে পারেন!’’

কেউ ভাবতে পারেন, কেউ পারেন না।

সেই ‘বিপন্নতার বিস্ময়’ নিয়েই কোথায় যেন অচেনা এক পাখির ভয়ার্ত ‘ভার্চুয়াল’ ডাক শুনছে কেউ!

(তথ্যসূত্র: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল আবেদিন, সুস্মিত হালদার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mobiles adda people
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE