Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

জমি হয়েছে বিক্রি, মালিক জানেনই না

বাড়ির সদস্যেরা ছুটলেন চাপড়া ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। সব শুনে কর্তারা জানিয়ে দিলেন, এ ক্ষেত্রে তাঁদের আর কিছুই করার নেই। জানানো হল অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভুমি সংস্কার)-কে।

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:২০
Share: Save:

তিন ভাইয়ের নামে জমি। দুই ভাই মারা যাওয়ার পরে তাঁদের সন্তানেরা সিদ্ধান্ত নেন, জমিটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে রেজিস্ট্রি করে নেবেন। কিন্তু ‘সার্চিং’ করাতে গিয়ে চমকে ওঠেন তাঁরা। চাপড়ায় তাঁদের বাড়ি সংলগ্ন ছয় শতক জমিটা আর তাঁদের নামে নেই। হয়ে গিয়েছে অন্যের নামে। তাঁরা কিছু জানেন না। মাথার উপরে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা।

বাড়ির সদস্যেরা ছুটলেন চাপড়া ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। সব শুনে কর্তারা জানিয়ে দিলেন, এ ক্ষেত্রে তাঁদের আর কিছুই করার নেই। জানানো হল অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভুমি সংস্কার)-কে। না, সেখান থেকেও বিশেষ সাড়াশব্দ এল না। বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হল পরিবারটি। বাড়ির সদস্য সুজয় দত্ত বলছেন, “ভাবুন এক বার! আমাদের জমি। অথচ সেটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে। একটা বিরাট চক্রান্ত কাজ করছে।”

প্রায় একই ঘটনার সাক্ষী কৃষ্ণনগরের এক দরিদ্র পরিবারও। পুরসভার পক্ষ থেকে তাদের সরকারি প্রকল্পে বাড়ি করে দেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ জানা গেল, সেই জমি নাকি তাদের নয়, অন্য এক জনের জমি। সেই জমি নাকি তিনি স্থানীয় এক জনের কাছে বিক্রিও করে দিয়েছেন। আরও অভিযোগ, যিনি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা। ভোটার কার্ড জালিয়াতি করে সেই জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।

নদিয়ায় এমন অভিযোগ উঠছে ভূরি-ভূরি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাতারাতি এক জনের জমি অন্যের নামে হয়ে যাওয়ার অভিযোগ। সেই জমি আবার নিজের নামে ফেরাতে হয়রান হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে যদি দেখা যায়, কোনও জমি নিয়ে শরিকি বিবাদ আছে বা কোনও শরিক হয়তো বাইরে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তো কথাই নেই! আর জমির মালিক যদি দীর্ঘদিন এলাকার বাইরে থাকেন, তা হলে তো সোনায় সোহাগা। অভিযোগ উঠছে, এক শ্রেণির জমি মাফিয়া বা দালালেরা বিভিন্ন ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে গিয়ে এই ধরনের জমি খুঁজে চিহ্নিত করছে। দফতরের এক শ্রেণির কর্মীও এই কাজে তাদের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ।

জমি মাফিয়ারা কতটা শক্তিশালী ও সঙ্ঘবদ্ধ, তার প্রমাণও মিলেছে বারবার। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করলে ঘটেছে রক্তপাত। একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে। বছর কয়েক আগেই কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছিতে সশস্ত্র ভাবে জমি দখল করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল জমি মাফিয়ারা। চলেছিল গুলি-বোমা। মারা গিয়েছিলেন অপর্ণা বাগ। গুরুতর জখম হন এক ছাত্র-সহ দুই মহিলা। সেই ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য জুড়ে। নাম উঠে এসেছিল শাসক দল ঘনিষ্ট জমি মাফিয়া লঙ্কা ঘোষের।

এতেও থামেনি জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম। গত বছরই হাঁসখালির গোবিন্দপুরে দেবোত্তর জমি নিয়ে বিবাদের জেরে খুনের ঘটনা ঘটে। সেখানেও নেপথ্যে উঠে এসেছিল জমি মাফিয়াদের ভূমিকার কথাই।

এত কিছুর পরেও কিন্তু থামেনি জমি দখল বা রাতারাতি জমির মালিকের নাম বদলে যাওয়ার ঘটনা। বারবার একই ঘটনা সামনে উঠে আসায় চিন্তিত জেলা প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ। কিছু ক্ষেত্রে তদন্তে ঘটনা সত্যি বলে প্রমাণ হওয়ার পরে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে অভিযোগ করাও হয়েছে।

এই সব অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন নয় তা পরিষ্কার হয়ে যায় জেলাশাসক সুমিত গুপ্তের কথাতেও। তিনি বলেন, “খুব বেশি না হলেও এমন অভিযোগ পাচ্ছি। যেখানে যেখানে তদন্তে ভুয়ো নথি জমা দিয়ে মিউটেশন বা দলিল করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, সেখানে আমরা আসল মালিকের নামে রেকর্ড সংশোধন করে দিয়েছি। একাধিক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।”

কিন্তু তার পরেও ছবিটা একটুও বদলেছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Land Owneship
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE