Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মাথায় পড়ল এলোপাথাড়ি কোপ

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীকে যত্ন করে ওষুধ খাইয়ে গিয়েছিলেন। যাত্রা ভালবাসতেন। অন্য সময় হলে হয়তো দেখার জন্য থেকে যেতেন।

মনুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

মনুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

সম্রাট চন্দ
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৮
Share: Save:

রাত তখন বেশি হয়নি। তেত্রিশ বছর আগের এক শীতের সন্ধ্যা। গ্রামের রাস্তায় লোক কমে এসেছিল। বাড়ির থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে ফুলিয়া রঙ্গমঞ্চে চলছিল যাত্রা। পালার উদ্বোধন সেরে বাড়ি ফিরছিলেন বছর চুয়ান্নোর সিপিএম নেতা নদিয়া জেলা পরিষদের তৎকালীন সদস্য মনুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীকে যত্ন করে ওষুধ খাইয়ে গিয়েছিলেন। যাত্রা ভালবাসতেন। অন্য সময় হলে হয়তো দেখার জন্য থেকে যেতেন। কিন্তু স্ত্রী অসুস্থ থাকায় সাড়ে ছটা নাগাদই পা চালিয়েছিলেন বাড়ির দিকে। মাফলারটা গলায় জড়িয়ে টর্চ হাতে ফুলিয়া-তাহেরপুর রোড ধরে হনহন করে হাঁটছিলেন বাড়ির দিকে। যখন বাড়ি থেকে তিনি মেরেকেটে ১০০ মিটার দূরে ঠিক তখনই রাস্তার পাশের অন্ধকার সরু রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসেছিল জনা কয়েক দুষ্কৃতী। হাতে ধারাল অস্ত্র। মুহূর্তে তারা ঘিরে ধরে মনুগোপালবাবুকে। তার পর গলায়, মাথায় এলোপাথাড়ি অস্ত্রের কোপ পড়তে থাকে। সন্ধ্যার বাতাস আর গলি নিস্তব্ধতা খানখান করে ছড়িয়ে পড়ে আক্রান্তের আর্তনাদ।

অনেকটা পরে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। ১৯৮৬ র ২ জানুয়ারি মনুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় এমন নৃশংসভাবে খুন হয়ে যান। এলাকার কিছু অপরাধীর কাজের প্রতিবাদ করায় তারাই শত্রু হয়ে উঠেছিল বলে অনেকের অনুমান।

এই রাস্তায় খুন হন মনুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

আদতে দক্ষিণপন্থী পরিবারে জন্ম হলেও ছাত্রজীবনেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন বাম রাজনীতিতে। হুগলির কোন্নগরের বাড়ি ছেড়ে প্রথমে কাশিমবাজার, পরে ফুলিয়া উপনগরীতে এসে বসবাস শুরু করেন। পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে পার্টি সদস্যপদ লাভ। ফুলিয়া উপনগরীতে যন্ত্রচালিত তাঁতের মিলে কাজ করার সময়ে বাম রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।

ভর সন্ধ্যাবেলা নিজের পাড়াতেই আক্রান্ত হন তিনি। সাধারণত সাইকেলে যাতায়াত করলেও সে দিন পায়ে হেঁটেই বেড়িয়েছিলেন। ফুলিয়া উপনগরীর বুক চিরে চলে যাওয়া ফুলিয়া-তাহেরপুর রোড। রাস্তার দু’ধারেই ঠাসা বাড়ি। ঠাণ্ডার জন্য দরজা-জানলা বন্ধ। তবু তাঁর আর্তনাদ অনেকেরই শোনার কথা। কেউ কেন এলেন না সাহায্যের জন্য? দুষ্কৃতীদের কি চেনা কেউ? সেই সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও।

তবে তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে যে হামলাকারীরা বিশদে জানত তা স্পষ্ট। তাঁর ফেরার রাস্তায় আগে থেকেই ওঁত পেতেছিল দুষ্কৃতীরা। নদিয়া জেলা পরিষদের দু’বারের নির্বাচিত সদস্যের (খুন হন যখন তখনও তিনি জেলা পরিষদের সদস্য) হত্যার অভিঘাত সেই সময়ে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল উদ্বাস্তু-অধ্যুষিত জনপদকে। পরের দিন কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এলাকা। রেল অবরোধ, বনধ, বিক্ষোভ—সবই হয়েছে। তদন্তে নিয়ে আসা স্নিফার ডগ তাঁর যাতায়াতের পথের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে থেমে যায়। খুনের ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাঁরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। স্ত্রী আলো বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “সে দিনের স্মৃতি মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠি। যাত্রার উদ্বোধনে গিয়ে আর এল না। ফিরল তাঁর মৃতদেহ!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Murder CPM Leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE