Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লোডশেডিং হতেই ঘরে ঢুকল খুনিরা

হঠাৎ লোডশেডিং। হ্যারিকেন ধরানো হয়েছে সবে মাত্র। আচমকা ঘরে ঢুকে পড়ল জনা আটেক দুষ্কৃতী।

ক্ষৌণীশ বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র

ক্ষৌণীশ বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
হাঁসখালি শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩০
Share: Save:

দিনটা ছিল বুধবার। বগুলার হাটবার।

দুপুরে একপশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। দুপুরের বৃষ্টি আর হাটের ক্লান্তি নিয়ে বগুলা বাজার যেন কিছুটা জবুথবু। রানাঘাট থেকে কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন কংগ্রসের জনপ্রিয় ও দাপুটে নেতা ক্ষৌণীশ বিশ্বাস। আর পাঁচটা দিনের মতোই ১৪ মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর-টাদর করে সন্ধে ৭টা নাগাদ পাটের গদিঘরে এসে বসলেন তিনি।

গদিঘরে তখন বসে আছেন জনা কয়েক পাটের ব্যবসায়ী। ব্যবসা নিয়ে টুকটাক কথা হচ্ছে। সন্ধে ৭টা ৩৫। হঠাৎ লোডশেডিং। হ্যারিকেন ধরানো হয়েছে সবে মাত্র। আচমকা ঘরে ঢুকে পড়ল জনা আটেক দুষ্কৃতী। সরাসরি পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হল ক্ষৌণীশকে। গদির দুধসাদা চাদর লালে ছুপিয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।

ক্ষৌণীশ বিশ্বাস যেখানে খুন হন। নিজস্ব চিত্র

আতঙ্কে তখন কাঁপছে ঘরের ভিতরে হাজির অন্যেরা। এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুষ্কৃতীরা। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন শ্যামল পাত্র নামে এলাকার এক যুবক। গুলি ছিটকে এসে লাগল তাঁর মাথায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন তিনিও। আততায়ীরা কলোনির রাস্তায় ঝুপসি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল দোকানপাট। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গোটা এলাকায়। পাশের দোকানে চা আনতে গিয়েছিলেন ক্ষৌনীশের ভাই শশাঙ্ক বিশ্বাস। গদিঘরের দিক থেকে গুলির শব্দ শুনে তিনি যত যখন ছুটে এলেন, তত ক্ষণে সব শেষ। রক্তে মাখামাখি দাদাকে নিয়ে তিনি ছুটলেন বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানালেন, আর কিছু করার নেই।

দিনটা ১৯৮৬ সালের ২৩ জুলাই। ক্ষৌণীশ তখন হাঁসখালি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। বাড়ি বগুলায় হলেও কর্মীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কেবল হাঁসখালির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দাপুটে নেতা চষে বেড়াতেন জেলা জুড়ে। তাঁর দাপট এতটা ছিল সিপিএম মধ্যগগনে থাকা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত সমিতি ছাড়াও ওই ব্লকের ১৩টির মধ্যে ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে রেখেছিল কংগ্রেস। জেলা পরিষদের তিনটির মধ্যে একটা আসনও তাদেরই দখলে। সেই নেতা খুন হয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে!

খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে জড়ো হতে থাকেন শ’য়ে-শ’য়ে মানুষ। পুলিশ আসে। আসেন জেলা কংগ্রস নেতারা। পরের দিন জেলা জুড়ে অঘোষিত বন্‌ধ পালিত হয়।

শশাঙ্ক বিশ্বাস ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সেই তালিকায় স্থানীয় দুষ্কৃতীদের পাশাপাশি সিপিএম কর্মীদের নামও ছিল। কিন্তু আসল অভিযোগ ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের। কেননা খুনের চক্রান্তকারী হিসাবে নাম দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা প্রাক্তন মন্ত্রী আনন্দমোহন বিশ্বাসের। শশাঙ্ক এখন তৃণমূলে এবং নদিয়া জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ। তাঁর দাবি, “দাদার সঙ্গে তখন আনন্দমোহন বিশ্বাসের বিরোধ চরমে। যে কারণে আমাদের তখন মনে হয়েছিল, উনিও এই খুনের চক্রান্তে জড়িত।”

আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক নেতা খুনের মতো এই খুনেরও কোনও কিনারা হয়নি। আনন্দমোহন বিশ্বাস ছাড়া বাকি সব অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। সত্যজিৎ বিশ্বাস হত্যার মতো এই খুনেরও তদন্ত করতে নেমেছিল সিআইডি।

শশাঙ্কের আক্ষেপ, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়ে দিল সিআইডি। সেখানেই শেষ হয়ে গেল মামলা। আমরা দাদার খুনের সুবিচার পেলাম না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Congress Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE