নবদ্বীপে ছাপা বই। নিজস্ব চিত্র।
নব্যন্যায়ের চর্চা তখন মিথিলা ছাড়া আর কোথাও তেমন হত না। ন্যায়ের উঁচু বেড়া টপকে নব্যন্যায়ের নতুন চিন্তা ধারণ করাই এক রকম অসম্ভব ছিল। নবদ্বীপে স্মৃতি, ন্যায়, কাব্য, অলঙ্কারের অসামান্য সব চিন্তকেরা নিজেদের গুরুকুল রক্ষা করতে করতেই তখন স্থির করলেন, চিন্তার সাম্রাজ্য বাড়াতেই হবে। কিন্তু মিথিলা রাজি ছিল না। এমন একজনকে তাই নবদ্বীপ তখন খুঁজছিল, যিনি পুথি আনতে না দিলেও জ্ঞানের সারটুকু মিথিলা থেকে নিয়ে চলে আসতে পারবেন।
কিংবদন্তি রয়েছে, বাসুদেব সার্বভৌম ছিলেন সেই লোক। কথিত রয়েছে, একবার তাঁর মা তাঁকে আগুন আনতে পাঠিয়েছিলেন। বালক বাসুদেব চলে যান একটি টোলে। টোলের পণ্ডিত তখন তাঁর পরীক্ষা নেন। তিনি বলেন, যেখানে আগুন জ্বলছে, সেখান থেকে আগুন নিয়ে নিতে। সবাই শিউরে উঠেছিলেন। ছোট বাসুদেব কী করে আগুন থেকে আগুন নেবেন? কিন্তু বাসুদেব জল ঢেলে মাটি কাদা করে পুরু করে সেই কাদা দুই হাতে নিয়ে তার উপরে রাখলেন একটি জ্বলন্ত কাঠ।
মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল বালকের সেই বুদ্ধির কথা। নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা তারপরে বাসুদেবকেই দায়িত্ব দিলেন মিথিলা থেকে নব্যন্যায় শিখে আসতে। কিন্তু বাসুদেব মিথিলা গেলে, সেখানকার পণ্ডিতেরা তাঁকে কোনও পুথি নবদ্বীপে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেননি। বাসুদেব তখন পুথিগুলি মুখস্থ করে ফেললেন। নবদ্বীপে ফিরলে তাঁর মুখ থেকে তত্ত্বের সার কথা শুনলেন গঙ্গার ধারের বিদ্যানগরীর চিন্তকেরা। শোনা যায়, তারপর থেকে নব্যন্যায় চর্চায় মিথিলাকেও পিছনে ফেলে দেয় নবদ্বীপ।
এই যে কাহিনি, তা কিংবদন্তির মতোই প্রচলিত ছিল নবদ্বীপে। এবং সেখান থেকেই এই নগরীর আত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। বোঝা যায়, নবদ্বীপের গরিমা তার বিদ্যাচর্চাতেই। এই নগরী সেই সব কাহিনিই বিশ্বাস করতে ভালবাসে, যেগুলিতে তার বিদ্যাচর্চার অভিমান ফুটে ওঠে। কোনও নগরী গর্ব করে তার রাজনৈতিক ইতিহাস বা নিসর্গ নিয়ে, কেউ তার প্রশাসনিক ঐতিহ্য নিয়ে, কোনওটি তার প্রাসাদ বৈভব নিয়ে, কোথাও বা ধর্মস্থানের মাহাত্ম্য নজর কাড়ে বেশি। কিন্তু নবদ্বীপের অহঙ্কার তার পাঠচর্চা। তাই এই শহর এক গরিব চিন্তককে নায়ক করে কাহিনি তৈরি করতে পারে। ভালবেসে বিশ্বাসও করে।
বাসুদেবের পরের প্রজন্মই এই শহরের দুই সন্তান মধ্যযুগের দুই বিখ্যাত চিন্তক বিশ্বরূপ ও বিশ্বম্ভর। দু’জনকেই আশ্রয় দিয়েছিলেন আর এক পণ্ডিত অদ্বৈত। এই এক পণ্ডিত, যিনি জীবনের সায়াহ্নে এসে নবদ্বীপ থেকে চলে গিয়েছিলেন শান্তিপুরে। কিন্তু তিনি নবদ্বীপেই পাঠচর্চা করতেন। কিন্তু তাঁর চিন্তার গতি বদলে যাওয়ার পরে নবদ্বীপের পাঠ-শৃঙ্খলার সঙ্গে ভাবনার সংঘর্ষ শুরু হয়। তাঁর নাম অদ্বৈত হলেও কমলাক্ষ পণ্ডিত ভক্তির শক্তিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। শুরু করেছিলেন ভাগবৎ-চর্চা। এ এমন এক চর্চা যা কেবল পাঠভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকার নয়, তা অনুশীলন করতে হয় জীবনে। সেই অনুশীলনেই শাশ্বত পাঠচর্চার সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য।
সেই সংঘাতের রূপ টের পেয়েছিলেন সনাতন নবদ্বীপের সন্তান বাসুদেবও। পুরীতে চৈতন্যকে দেখে তিনি প্রথমে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সম্ভবত ভক্তিধর্মের অনুশীলন তাঁর শাশ্বত পাঠ-ধর্মের কাছে ‘ভাগবৎ বিকার’ বলে ঠেকেছিল। ঘনঘন মূর্চ্ছা যাওয়া, লম্বা শ্বাস নেওয়া, অচেতন অবস্থায় কৃষ্ণ নাম—তিনি প্রথমে অস্বাভাবিক বলেই মনে করেছিলেন।
পরে চৈতন্য তাঁকে নিজের শাস্ত্রে টেনে আনেন। সে কথা বাসুদেব স্বীকারও করতে পেরেছিলেন অকপট ভাবে। শেষ জীবনে তিনি বলেছিলেন, বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, ন্যায়, স্মৃতি, সাংখ্য, মীমাংসা, যোগ সবই পড়েছেন, কিন্তু ব্রজের রাখাল বালকের বাঁশির সুর যেমন টানে, তেমনটি করে আর কেউই আকর্ষণ করে না।
এই কথাটি নবদ্বীপের টোলে পড়াতে পড়াতেই বুঝেছিলেন বিশ্বম্ভর। কিন্তু তখনও তিনি নতুন পাঠচর্চার শৃঙ্খলাটি তৈরি করে ফেলতে পারেননি। কিন্তু সংঘাত তৈরি হয়েছিল। যে সংঘাতের জন্য তাঁকে নবদ্বীপের পাঠ-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত বলেই মনে করা হয়েছিল। তাঁর টোল উঠে গিয়েছিল। তিনি পাঠ দিতে অক্ষম হয়ে উঠেছেন বলে মনে করেছিলেন শহরের পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা। তিনি যে তখন নিজেই আস্তে আস্তে পাঠ্য হয়ে উঠছেন।
এই যে নতুন চিন্তা, তার রূপটি কিন্তু ধরা পড়ে মুরারী গুপ্তের কড়চায়। পরে তা ধরা রয়েছে বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবতেও।
মুরারী ছিলেন প্রথাগত শাস্ত্রচর্চায় পণ্ডিত। তিনি নিজের চোখেই দেখেছিলেন কী ভাবে জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র, নীলাম্বর চক্রবর্তীর মতো দাপুটে পণ্ডিতের দৌহিত্র ভাগবৎ ভাবনায় চিন্তার নতুন পাঠ তৈরি করে ফেললেন। সেই দুই পথের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল মুরারীর লেখায়। মুরারীকে সেই প্রকাশভঙ্গি আবিষ্কার করতে হয়েছিল, যেখানে এই নতুন ভঙ্গিটিকে তিনি বিদ্যাভাবনায় স্থান দিলেন। চৈতন্য ভাগবতে যার বিকাশ আরও স্পষ্ট। বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী যাকে আরও প্রতিষ্ঠা দেন। তা আলাদা শাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এটি একটি আলাদা দর্শন চিন্তার ঘরানা ও ভঙ্গি বলেও প্রতিষ্ঠা পায় রূপ, জীব গোস্বামীর পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃতে।
সেখানে কৃষ্ণ কেন্দ্রীক ললিত-ভাবনার যে শিকড়টি দশম শতকে প্রধানত দক্ষিণ ভারতে ভক্তিচর্চা থেকে তৈরি হয়েছিল, তাকে বিদ্যাচর্চার শৃঙ্খলায় বাঁধা হল। যে ললিত-ভাবনা সমান শক্তিতে ধারণ করে রোষও। যে ভাবনায় রাখালও রাজপুত্র হয়ে ওঠেন। এক দিকে ললিত-ভাবনা আর এক দিকে বিদ্যা-শৃঙ্খলা, এই রীতি নবদ্বীপ তারপর থেকে কোনওদিনই ছাড়তে পারেনি। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy