Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Naka checking

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় নাকা জেলা জুড়ে

চাপড়ার সুনসান গাছা রোডে আচমকা নাকা চেকিং শুরু করেছে পুলিশ। হেডলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছিল একটা গাড়ি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে থামতে বলেন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। গাড়ি থামল। কিন্তু পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে অন্ধকারে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল চালক। 

রাতের রাস্তায় পুলিশের নাকা চেকিং। কোনও গাড়ির খোলানো হল ডিকি। প্রশ্নের মুখে পড়ল ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িও। নাকাশিপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র

রাতের রাস্তায় পুলিশের নাকা চেকিং। কোনও গাড়ির খোলানো হল ডিকি। প্রশ্নের মুখে পড়ল ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িও। নাকাশিপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
নদিয়া শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৫৮
Share: Save:

রাত তখন প্রায় ৯টা।

চাপড়ার সুনসান গাছা রোডে আচমকা নাকা চেকিং শুরু করেছে পুলিশ। হেডলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছিল একটা গাড়ি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে থামতে বলেন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। গাড়ি থামল। কিন্তু পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে অন্ধকারে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল চালক।

পুলিশ তড়িঘড়ি গাড়ি তল্লাশি শুরু করল। সিটের নীচ থেকে পাওয়া গেল একটা দেশি পাইপগান আর দুটো কার্তুজ। পরে সেই গাড়ির সূত্র ধরেই গাছা এলাকা থেকে বছর বাইশের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়।

এমন ঘটনা আরও ঘটেছে নদিয়া জেলায়। নাকা চেকিংয়ের সময়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, গাঁজা, হেরোইন-সহ প্রচুর ফেন্সিডিল। নির্বাচনের সময় ছাড়াও প্রায় সারা বছরই জেলায় বিভিন্ন থানা এলাকায় আচমকা নাকা চেকিং করে পুলিশ। সেই সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক পাচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা নতুন নয়।

বুধবার কৃষ্ণনগরে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নাকা চেকিং বাড়ানোর নির্দেশ দেন। জেলার পুলিশ কর্তাদের দাবি, শুধু কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার ভিতরে সব থানা মিলিয়ে গড়ে ৫০টির মত নাকা চেকিং হয়। আর সবটাই হয় আচমকা। কবে কখন কোথায় নাকা চেকিং হবে তা ঠিক করেন পুলিশ সুপার নিজে। সেই সময়ে জেলার কোন অফিসার কোথায় থাকবেন সেটাও ঠিক করেন তিনিই। সঙ্গে থাকা বডি ক্যামেরা বা হ্যান্ডিক্যামে সবটা ভিডিয়ো করে রাখা হয়। একই ভাবে গুরুত্ব দিয়ে নাকা চেকিং হয় বলে দাবি করছেন রানাঘাট পুলিশ জেলার অফিসারেরাও।

দিন কয়েক আগেই সিসারঘাট দিয়ে জলঙ্গি নদী পার হয়ে করিমপুরে ঢোকার সময়ে বক্সিপুর ঘাটের আগে নাকা চেকিংয়ে ধরা পড়েছিল মুর্শিদাবাদের ডোমকলের কামুরদিয়া এলাকার এক বাসিন্দা। তার থেকে একটা আগ্নেয়াস্ত্র ও দুটো কার্তুজ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, সে ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। বক্সিপুরে জলঙ্গি নদীর উপরে বাঁশের সাঁকোতে নাকা চেকিং করার সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-সহ এক দুষ্কৃতীকে ধরে ফেলে পুলিশ। ভীমপুর আবার নাকা চেকিংয়ে মোটরবাইক তল্লাশির সময়ে চালকের কোমর থেকে উদ্ধার হয় দেশি পিস্তল। এর বাইরেও গত কয়েক মাসে নাকা চেকিংয়ের সময়ে বেশ কিছু মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো পাচার করা হচ্ছিল বলে পুলিশ জেনেছে।

এমনিতেই সীমান্ত জেলা নদিয়া ভৌগলিক কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মুর্শিদাবাদ সীমানায় হোগলবেড়িয়া থেকে ধানতলা পর্যন্ত দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। ৮টি থানার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। আর এই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় এমন বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া নেই। ফলে এই সীমান্ত দিয়ে শুধু গরু, জাল নোট বা আসল নোট, ডলারের মতো সামগ্রী পাচার হয় না, সেই সঙ্গে মানুষও অবৈধ ভাবে পারাপার করে বলে অভিযোগ। ছোট আগ্নেয়াস্ত্র তো জামার ভিতরে করে পাচার করা কঠিন কিছুই নয়।

নদিয়ার সীমান্ত দিয়ে একাধিক বার পাচার হওয়ার সময়ে পুলিশ বা বিএসএফের হাতে ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে। নদিয়ারই থানারপাড়া ও কালীগঞ্জ এলাকা থেকে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তি ধরা পড়েছে। পুলিশেরই একাংশের মতে, এই জেলায় দুষ্কৃতীদের লুকিয়ে থাকার মতো জায়গার অভাব নেই। কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, ধুবুলিয়া থানা এলাকায় কয়েক বার অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে।

গত বছর সরস্বতী পুজোর আগের রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালীন সকলের মাঝে গুলি করে খুন করা হয় কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসকে। তারও আগে দলীয় কার্যালয়ের ভিতরে ঢুকে গুলি করে খুন করা হয় তৃণমূলের হাঁসখালি ব্লক সভাপতি দুলাল বিশ্বাসকে। তদন্তে এসেছিল বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের যোগ।

ফলে সব মিলিয়ে নদিয়া নিরাপত্তা পাখির চোখ। তার উপরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিধানসভা ভোট। তার আগে বাড়তে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এমনকি ভিন্ রাজ্য থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও ঢুকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলা পুলিশের পোড় খাওয়া গোয়েন্দারা। কল্যাণী ও গয়েশপুর এলাকাতেও আগ্নেয়াস্ত্র হানানোর কারখানার খোঁজ মিলেছে।

পুলিশের দাবি, নাকা চেকিং বাড়ানোয় চাপড়া, করিমপুর ছাড়াও কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার মধ্যে হোগলবেড়িয়া থানায় প্রায় আটশো বোতল ফেনসিডিল, থানারপাড়া থানা এলাকা থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও দুটো কার্তুজ এবং ৫০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে একাধিক লোক। পলাশিপাড়ার কুলগাছি ও বাউর থেকে ৫৭ গ্রাম হেরোইন-সহ এক জনকে ধরা হয়েছে নাকা চেকিংয়ে। কালীগঞ্জ থানার পুলিশ নাকা চেকিংয়ে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র ও দুটো কার্তুজ পেয়েছে। দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার পুলিশও সম্প্রতি নাকা চেকিং করার সময়ে দু’দিনে ৫০০ ও ৫৫ বোতল করে ফেনসিডিল ধরেছে।

এর পরও জেলায় নাকা চেকিং বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা এবং অন্য কিছু জেলাতেও নাকা চেকিংয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা নিয়ে রাজনৈতিক দলের লোক ধরা পড়েছে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার জাফর আজমল কিদোয়াই বলছেন, “আমরা এখনই প্রতিটি থানা এলাকায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নাকা চেকিং করি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে সেটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Naka checking arms smuggling Nadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE